অন্ধকার যুগের মানুষগুলোকে আচরণিক সৌষ্ঠবে পৃথিবীর সেরা ও সোনালি মানুষে পরিবর্তন করেছিলেন প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
“নিশ্চয়ই আপনি নৈতিক-চরিত্রের সর্বোচ্চ মানের ওপর অধিষ্ঠিত।” (সূরা কলম, ৬৮:৪)
রাসূল (সা) সাহাবাদেরকে শিক্ষাদান ও উৎসাহ প্রদানের নিমিত্তে বলেছেন—
“উত্তম আচরণের পূর্ণতা দানের জন্যই আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।”
উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.) চমৎকারভাবে প্রিয় নবিজির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন—
“রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র কুরআন মাজীদ-এর প্রতিচ্ছবি ছিলেন।”
এই বক্তব্যের সাথে মিলিয়ে অনেকেই বলেছেন, রাসূল (সা) যখন পথ চলতেন, মনে হতো কুরআন কারীম হেঁটে চলেছে।
সুন্দর চরিত্র জান্নাতে প্রবেশ করাবে
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন :
‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—‘কোন আমলের দ্বারা মানুষ বেশি জান্নাতে প্রবেশ করবে?’ তিনি বললেন, “আল্লাহ-ভীতি, সদাচার ও উত্তম চরিত্র।”’ (তিরমিজি, ২০০৪)
নবিজির এই হাদীস থেকে এ-কথা প্রতীয়মান হয় যে, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত—ইসলামের এসব মৌলিক আমলের পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল হচ্ছে মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করা। পরিবারে স্ত্রী-সন্তানের সাথে, সমাজে প্রতিবেশীর সাথে, অফিসে সহকর্মীদের সাথে, রাষ্ট্রে জনগণের সাথে রূঢ়, অসৎ ও অশোভন আচরণ কখনোই কাম্য নয়। রাসূল (সা) ছোট থেকে বড়, নারী থেকে পুরুষ, বন্ধু থেকে শত্রু সবার সঙ্গে অত্যন্ত মাধুর্যপূর্ণ আচরণ করতেন। তাঁর আচরণে মুগ্ধ হয়ে শত্রুও পরিণত হয়েছিল বন্ধুতে।
শিশুদের সাথে প্রিয় নবি
আরবের বাবা-মায়েরা কোনো নবজাতক শিশু নিয়ে এলে, নবিজি খেজুর চিবিয়ে তাঁর লালা-মিশ্রিত খেজুরের রস বাচ্চাদের খাইয়ে দিতেন। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞান প্রিয় নবির এ অভ্যেসটিকে অত্যন্ত সায়েন্টিফিক আখ্যা দিয়েছে। কেননা, এর ফলে শিশুদের খাদ্যনালী ও পরিপাকতন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
নবিজি শিশুদেরকে কোলে নিতেন, চুমু খেতেন, আদর করে মাথায় বুলিয়ে দিতেন স্নেহের পরশ। তিনি শিশুদের সাথে মজা ও খেলাধুলাও করতেন। কোনো শিশু যদি কোথাও কোনো ভুল করত, তিনি কখনো বকাঝকা করতেন না। বরং নির্মল হাসি দিয়ে মোলায়েম ভাষায় তা শুধরে দিতেন। এমনকি শিশুরা যদি নামাজের সময়েও দুষ্টুমি বা খেলাধুলা করত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ধমক দিতেন না। এ ছাড়া তিনি শিশুদেরকে সালাম দিতেন। আনাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে এসেছে—
“একবার রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। পথে বালকদের সাথে দেখা হলে তাদের সালাম দিলেন, তাদের মাথা স্পর্শ করলেন এবং তাদের জন্য দুআ করলেন।”
এ-হাদীসের শিক্ষা হলো—বড়-ছোট, ধনী-দরিদ্র, ছাত্র-শিক্ষক, জ্ঞানী-মূর্খ, আলিম-সাধারণ মানুষ প্রত্যেকে একে-অপরকে সালাম দেবে।
সাহাবাদের সাথে নবিজির আচরণ
কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
“অতঃপর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমতের কারণে আপনি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলেন। আর যদি আপনি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন সংকল্প করবেন, তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালোবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৫৯)
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় এ আয়াতকে সামনে রেখে সাহাবাদের সাথে চলাফেরা করতেন। সর্বদা হাসিমুখে কথা বলতেন তাদের সাথে। তিনি বলতেন, “এ হাসিটাও মুমিনের সদাকা।”
সাহাবাদের যখন মন খারাপ হতো, বাসা-বাড়িতে মনোমালিন্য হতো কিংবা ক্ষুধার সময়টাতে খাওয়ার মতো কিছু থাকত না, তখন তাঁরা নবিজির সান্নিধ্যে চলে আসতেন। প্রিয় নবির সান্নিধ্য ও সাহচর্যে তাঁদের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মুহূর্তেই লাঘব হয়ে যেত।
নবিজির সঙ্গে কেউ কথা বলতে এলে, তাকে খুব গুরুত্ব দিতেন তিনি। পারস্পরিক আলোচনার সময় তিনি অন্যের কথা মনোযোগ-সহকারে শুনতেন। অপরজন চেহারা না ফেরানো পর্যন্ত তিনি তার দিক থেকে চেহারা ফেরাতেন না। আর কেউ তাঁকে কানে কানে কিছু বলতে চাইলে, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি মাথা সরাতেন না।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘এক বেদুইন মসজিদে প্রসাব করে দিলো। লোকেরা তার উপর চড়াও হওয়ার জন্য ছুটে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে বললেন: “তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রসাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। তোমাদেরকে সহজ করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠিন করার জন্য নয়।”’ (বুখারি, ৬১২৮)
নবিজি তাঁর প্রিয় সাহাবাদের জন্য মন খুলে দুআ করতেন। যারাই তাঁর একান্ত দুআ লাভে ধন্য হয়েছেন, তাঁরাই পরবর্তী সময়ে জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
এ ছাড়া রাসূল (সা) তাঁর সাহাবাদের যেকোনো গুণের অকৃত্রিম প্রশংসা করতেন। সাহাবাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কখনো কখনো ছুঁড়ে দিতেন বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন। তাঁদের সাথে নির্মল হাসি-কৌতুক করতেন তিনি।
নবিজি সকল প্রকার আত্মম্ভরিতার ঊর্ধ্বে থেকে সাহাবাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। মসজিদে নববী নির্মাণ কিংবা খন্দক যুদ্ধে পরিখা খনন—সকল ক্ষেত্রেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এ ছাড়া রাসূল (সা) তাঁর সাহাবাদের পরামর্শকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতেন। বদর যুদ্ধের সময় প্রথমে এক জায়গায় সেনাছাউনি স্থাপন করা হলেও, একজন সাহাবির পরামর্শে নবিজি তা স্থানান্তর করেন।
কর্মচারীর সঙ্গে প্রিয় নবি
সাধারণত অতি তুচ্ছ কারণেই মানুষ তার অধীনস্থদের সাথে খারাপ আচরণ করে। কিন্তু রাসূল (সা) কখনোই এমনটি করেননি। আয়িশা (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কোনো সেবককে এবং কোনো নারীকে মারধর করেননি।” (আবু দাউদ, ৪৭৮৬)
আনাস (রা.) বলেন, আমি ১০ বছর নবিজির খিদমত করেছি। কিন্তু তিনি কখনো আমার প্রতি ‘উঃ!’ শব্দটি করেননি। এ কথা জিজ্ঞেস করেননি—“তুমি এ কাজ কেন করলে এবং কেন করলে না?” (বুখারি, ৬০৩৮)
স্ত্রীগণের সাথে যেমন ছিলেন তিনি
প্রতিদিন আসরের নামাজ শেষে নবিজি তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে যেতেন, তাঁদেরকে সালাম দিতেন আর তাঁদের জন্য দুআ করতেন। (মুসলিম, ১৪৭৪)
নবিজি স্ত্রীদের সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং তোমরা যেমন ঘরে কাজ করো তেমনি কাজ করতেন।” (মুসনাদ আহমাদ, ২৫৩৮)
আয়িশা (রা.) পেয়ালার যেখানে মুখ রেখে পান করতেন, নবিজি সেখানে মুখ রেখে পান করতেন। একই হাড্ডির গোশত আয়েশা (রা) খেয়ে নবিজির হাতে দিলে, তিনি সেখান থেকে খেতেন, যেখান থেকে আয়েশা (রা.) খেয়েছেন। (সুনান আন-নাসাঈ, ৭০)
হাদীসে এসেছে—নবিজি ও তাঁর স্ত্রী মাইমুনা (রা.) একই সঙ্গে একই মগ দিয়ে একই পাত্রের পানি দিয়ে গোসল করেছেন। (সুনান আন-নাসাঈ, ২৪০)
প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যবহার
প্রতিবেশীর সঙ্গে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভালো আচরণ করতেন। কখনো কোনো আচরণে তাদেরকে কষ্ট দিতেন না। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَمَنْ كان يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ جَارَهُ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে।” (মুসলিম, ৪৭)
প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণের পাশাপাশি নবিজি সবসময় তাদের খোঁজখবর রাখতেন। এমনকি এ ব্যাপারে তিনি সাহাবাদেরকেও আদেশ করেন। আবু যর (রা.)-কে নবিজি বলেন, “আবু যর! তুমি তরকারি রান্না করলে তাতে পানি (বা ঝোল) একটু বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো।” (মুসলিম, ২৬২৫)
রাসূল (সা) বলেছেন, “ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেটপুরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।” (আল-আদাবুল মুফরাদ, ১১২)
যুদ্ধ-বন্দীদের সঙ্গে যেমন ছিলেন তিনি
বদরের যুদ্ধবন্দীদের মদিনায় আনার পর রাসূল (সা) সাহাবিদের মধ্যে তাদেরকে ভাগ করে দেন। আর তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করার আদেশ দেন। সাহাবিগণ নবিজির এই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। নিজেরা তুলনামূলক কম দামি খাবার খেয়ে, দামিটা বন্দীদের খাওয়ালেন। সাহাবারা আরবের সাধারণ খাদ্য খেজুর খেলেন আর বন্দীদের খাওয়ালেন মূল্যবান রুটি। (ইবনে হিশাম, ১/৬৪৪-৪৫)
ভিক্ষুকের সাথে আচরণ
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতটাই বিনয়ী ছিলেন যে, তিনি কখনো ভিক্ষুকের সাথেও রূঢ় ভাষায় কথা বলেননি। একবার এক বেদুইন ভিক্ষুক তাঁর চাদর ধরে টান দিয়ে শরীরে দাগ ফেলে দিলেও, নবিজি তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি। বরং তাকে হাসিমুখে সদাকা দিয়ে বিদায় করেছেন। (বুখারি, ৬০৮৮)
শত্রুদের সাথে আচরণ
আল্লাহর রাসূল (সা) শত্রুদের শত্রুতার জবাব দিয়েছিলেন দয়া ও প্রজ্ঞার সাথে। সবসময় তিনি তাঁর শত্রুদের জন্য হিদায়াতের দুআ করতেন। তিনি কামনা করতেন, যেন তারাও এক আল্লাহর গোলাম হয়ে যায়।
প্রাণীর প্রতি আচরণ
একবার রাসূল (সা) এক খেজুর বাগানে প্রবেশ করে একটি উট দেখতে পান। উটটি নবিজিকে দেখে কাঁদতে লাগল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এ উটের মালিক কে?” এক আনসারি যুবক এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটি আমার উট।’ নবিজি বললেন, “আল্লাহ যে তোমাকে এই নিরীহ প্রাণীটির মালিক বানালেন, এর ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় করো না? উটটি আমার কাছে অভিযোগ করেছে, তুমি একে ক্ষুধার্ত রাখো এবং কষ্ট দাও।” (আবু দাউদ, ২৫৪৯)
সবশেষে বলা যায়, প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুমহান আচরণ-দক্ষতার মাঝেই নিহিত আছে উম্মাহর মুক্তি, শান্তি এবং অবারিত কল্যাণের ফল্গুধারা। তাই সকলের উচিত, নবিজির আচরণমাধুর্যকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া।
Related Articles