পর্যায়ক্রমে সকল ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই || পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সৌজন্যবোধে তৈরি হোক ঐক্যের সেতু বন্ধন। কমে আসুক দূরত্ব। মজবুত হোক সম্প্রীতি।

Dr. Mizanur Rahman Azhari


mizan vai
আল্লাহর দেয়া ফিতরাতেই মানবের কল্যাণ

বিশ্বজগতের ছোট-বড়, দৃশ্যমান-অদৃশ্য যা কিছু রয়েছে, তার সব-ই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। যে সৃষ্টিকে যেভাবে সৃষ্টি করলে ভালো ও সুন্দর দেখাবে, নিঃসন্দেহে তিনি সেটিকে সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। কোনো সৃষ্টি যদি এর ব্যত্যয় ঘটায় বা ঘটাতে চায়, তবে তার জন্য ধ্বংস ও অকল্যাণ অনিবার্য।

অমোঘ ঘোষণা

আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি কাঠামোই হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর ও টেকসই। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন : 

“সুতরাং সকল জীবনাদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আল্লাহর আনুগত্যে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করো; আল্লাহর এই বৈশিষ্ট্য (ফিতরাত) আঁকড়ে ধরো, যে-বৈশিষ্ট্য দিয়ে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর সৃষ্টি(র এই বৈশিষ্ট্য) বদলে ফেলো না; এটাই সঠিক জীবনাদর্শ, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ (তা) জানে না।”   (সূরা রূম, ৩০:৩০)

প্রতিটি নবজাতক ফিতরাতের ওপর জন্মায়

কোনো নবজাতকের জন্ম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—যে পরিবারেই হোক না কেন, তার ধর্ম থাকে ইসলাম। পরবর্তী সময়ে পরিবার, পরিবেশ ও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সে ভিন্ন ধর্ম ও দর্শনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ-ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেন—

كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ، كَمَثَلِ الْبَهِيمَةِ تُنْتَجُ الْبَهِيمَةَ، هَلْ تَرَى فِيهَا جَدْعَاءَ"‏‏.‏

“প্রত্যেক নবজাতক ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদি বা নাসারা অথবা অগ্নি-উপাসক বানায়। যেমন—চতুষ্পদ জন্তু একটি নিঁখুত বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে (জন্মগত) কানকাটা দেখেছ? (বরং মানুষরাই তার নাক-কান কেটে দিয়ে বা ছিদ্র করে তাকে বিকৃত করে থাকে।)”   (বুখারি, ১৩৫৮)

ফিতরাতের দুটি মৌলিক অর্থ

এক. ফিতরাত মানে ইসলাম। অর্থাৎ ইসলামই মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। কেননা, এই ধর্ম মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের (By default nature) সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এ-কারণে ফিতরাত নষ্ট হয়ে যায়নি, এমন ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে। এই ফিতরাতের উপর জন্মের কারণ হলো—আল্লাহ তাআলা রুহের জগতে সকল মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাদের রব সম্পর্কে। সেখানে আল্লাহকেই সকলে রব হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এজন্যে মানুষমাত্রই তার কাছে ইসলামকে বড্ড চেনা চেনা মনে হয়, আপন অনুভব হয়। তাই, ইসলামের সৌন্দর্যকে যদি পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়া যায় কিংবা সঠিকভাবে ইসলাম প্রচার করা যায়, তা হলে মানবজাতির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইসলামের দিকে ধাবিত হবে, ইন শা আল্লাহ। 

দুই. ফিতরাত বলতে ‘যোগ্যতা’ বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিগতভাবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে স্রষ্টাকে চেনার ও তাঁকে মেনে চলার যোগ্যতা দিয়েছেন। মানবসভ্যতা বিবর্জিত গহীন জঙ্গলের কোনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীও যদি সুনীল আকাশের দিকে তাকায়, বহতা নদীর দিকে চোখ রাখে অথবা হিমেল হাওয়া শরীরে মাখে, তবে তারাও আপন স্রষ্টার সন্ধান পেয়ে যাবে।

ফিতরাতের দাবি

নিজেকে আল্লাহ তাআলার কাছে পূর্ণ সমর্পণ করাই ফিতরাতের দাবি। সব কাজ ফেলে রেখে নামাজে দাঁড়ানো, রোজার সময়ে কঠিন পিপাসাতেও পানি পান না করা কিংবা অনেক অর্থ খরচ করে বায়তুল্লাহয় গিয়ে ‘লাব্বাইক’ ধ্বনি দিতে পারা তখনই সম্ভব হয়, যখন ব্যক্তির ফিতরাত অবিকৃত অবস্থায় থাকে। প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁর উম্মাহকে ফিতরাতের ওপর অবিচল থাকার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। একজন সাহাবিকে তিনি বলেন—“যখন তুমি শয্যা গ্রহণ করবে বা বিছানায় যাবে তখন বলবে, ‘হে আল্লাহ! আমি আমার মুখমণ্ডল তোমার দিকে ফিরিয়ে দিলাম, আমার পিঠ তোমার আশ্রয়ে সোপর্দ করলাম, তোমার রহমতের আশা এবং তোমার আযাবের ভয় সহকারে আমার যাবতীয় বিষয় তোমার নিকট সোপর্দ করলাম। তুমি ব্যতীত প্রকৃত কোনো আশ্রয়স্থল ও পরিত্রাণের স্থান নেই। তুমি যে কিতাব নাযিল করেছ এবং যে নবি প্রেরণ করেছ, আমি তার উপর ঈমান আনলাম।’ তুমি যদি সেই রাতে মারা যাও তাহলে তুমি ফিতরাতের (ইসলামের) উপর মৃত্যুবরণ করলে। আর যদি তুমি সকালে উপনীত হও, তবে পর্যাপ্ত কল্যাণপ্রাপ্ত হয়ে সকালে উপনীত হবে।”   (বুখারি, ২৪৭, ৬৩১১)

ফিতরাতের সহজতর ব্যাখ্যা

এ পৃথিবীতে যা কিছু স্বাভাবিক, ভালো ও কল্যাণকর, তা-ই ফিতরাত। রাসূল (সা) বলেছেন, মিরাজের রজনীতে আমার সামনে দুটি পেয়ালা আনা হলো। তার একটিতে ছিল দুধ আর অপরটিতে ছিল শরাব। তখন জিবরীল (আ) বললেন, ‘এই দুটির মধ্যে যেটি চান, আপনি পান করতে পারেন’। আমি দুধের পেয়ালাটি নিলাম এবং তা পান করলাম। তখন বলা হলো, আপনি ফিতরাত বা স্বভাব ও প্রকৃতিকে বেছে নিয়েছেন। আপনি যদি শরাব নিয়ে নিতেন, তা হলে আপনার উম্মতগণ পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।

ফিতরাত ধ্বংস করার শয়তানি ষড়যন্ত্র

জীবনকে সার্থক ও অর্থবহ করার জন্য আল্লাহর দেয়া ফিতরাতকে আঁকড়ে ধরার কোনো বিকল্প নেই। তবে, মানুষকে তাদের স্বাভাবিক স্বভাব-প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বিতাড়িত শয়তান নানামুখী ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। সেসবের দু-একটি নমুনা এখানে তুলে ধরা হলো।

১. জীবনযাপন-রীতি পরিবর্তন :

পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন—

“আমি রাত্রিকে করেছি আবরণ। আমি দিনকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়।”   (সূরা নাবা, ৭৮:১০-১১)

রাতের অন্ধকার পরিবেশে মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরিত হওয়ায় মানুষের চোখে ঘুম-ঘুম ভাব আসে; বিছানায় গেলে ভালো ঘুম হয়। অপরদিকে, দিনে সূর্যের আলোতে শরীর থেকে মেলাটোনিন হরমোন হ্রাস পাওয়ার ফলে সবাই কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দিনে কাজ এবং রাতে ঘুম—এটাই সঠিক জীবনধারা। অথচ বর্তমান সময়ে অসংখ্য মানুষ মোবাইল, মুভি, ক্লাব, আড্ডা, হারাম রিলেশনশিপ ইত্যাদির কারণে রাতের ঘুমকে পরিত্যাগ করেছেন। এর ফলে নানা রকম জটিল ও দুরারোগ্য ব্যধিও বেড়ে চলেছে দিনদিন।

২. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন :

আধুনিক সময়ে মানুষ অধিক হারে প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্টফুড ও জিনগতভাবে পরিবর্তিত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। অথচ আগের যুগের মানুষরা ফরমালিন ও ক্যামিকেলমুক্ত খাবার গ্রহণ করতেন। আর এজন্য তারা এ-সময়কার দুনিয়াবাসীদের থেকে অনেক সুখী ও শক্তিশালী ছিলেন।

৩. অশ্লীলতার প্রসার :

বর্তমান সময়ে লোকদের থেকে শালীনতা ও লাজুকতা হারিয়ে যাচ্ছে। খোলামেলা পোশাক-আশাক পরিধান করাকে আধুনিকতা ও সাহসিকতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতাও বেড়ে চলেছে দিনকে দিন। ফলে, মানুষ যৌন সক্ষমতা ও সুখী দাম্পত্য জীবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। LGBTQ+ তথা নানা ধরনের বিকৃত যৌনাচারেও আকৃষ্ট হচ্ছে অনেকে। বলাই বাহুল্য, আল্লাহর দেয়া ফিতরাতকে ধ্বংস করার মিশনে এ-মুহূর্তে সবচেয়ে জঘন্যতম প্রচেষ্টা হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডারিজম।  

ট্রান্সজেন্ডারিজম কী?

ট্রান্সজেন্ডারিজম এসেছে মূলত Gender Dysphoria থেকে। যারা আল্লাহর দেয়া জেন্ডারে সন্তুষ্ট না, তারাই এই ফাঁদে আটকা পড়ছে। তারা মনে করে, তাদের পুরুষ বা নারী সত্তা ভুল দেহে আটকা পড়ে আছে। এক্ষেত্রে কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী দাবী করে, সমাজ তাকে নারী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য—যদিও সে দুই সন্তানের জনক হয়! অনুরূপভাবে, কোনো নারীর যদি নিজেকে পুরুষ মনে হয়, তা হলে সে পুরুষ—যদিও তার মাসিক হয় বা সে গর্ভবতী হয়! অর্থাৎ, দৈহিকভাবে না হলেও, মনে মনে তারা নারী বা পুরুষ। আর এজন্য তারা নাম, পোশাক-আশাক, বেশভূষা, চাল-চলন প্রভৃতি পরিবর্তন করে। এমনকি হরমোনজনিত চিকিৎসা ও সার্জারির মাধ্যমেও লিঙ্গ পরিবর্তনের বৃথা চেষ্টা করে থাকে।

ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিকতা

এ পৃথিবীতে কে কীভাবে জন্ম নেবে, কে কী খাবে, কার কোথায় জন্ম হবে, কার সাথে কার বিয়ে হবে—এগুলো সব আল্লাহ তাআলা কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত বিষয়। এগুলোতে নাখোশ হওয়া বা এগুলোর বিরুদ্ধাচারণ করা ঈমানহীনতার পরিচয় দেয়।

মনে মনে তো অনেক কিছুই হওয়া যায়!

মনে মনে অনেক কিছু হওয়ার সুযোগ থাকলেও, বাস্তবে তার সম্ভবপর নয়। অথচ অভিশপ্ত ইবলিস এই মনকেই মানুষের ধ্বংস সাধনের প্রধান অস্ত্র বানায়। সে মানুষের মনে বিভিন্ন অলীক, অবান্তর ও অসভ্য চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে সকলকে সুপথ থেকে বিচ্যুত করতে চায়। তাই এ-ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।   

হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার এক জিনিস নয়

ইন্টারসেক্স হলো এক ধরনের জন্মগত ত্রুটি (Genetic Disorder)। এই ইন্টারসেক্স মানুষগুলো সমাজে হিজড়া হিসেবে অধিক পরিচিত—যারা শারীরিক গঠনে, বিশেষ করে যৌনাঙ্গের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মিশ্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন। অন্যদিকে ‘ট্রান্সজেন্ডারিজম’ হচ্ছে মনের সমস্যা।

হিজড়ারা চাইলে তাদের সমস্যার জন্য চিকিৎসা নিতে পারেন অথবা আল্লাহ তাআলার পরীক্ষা হিসেবে ধৈর্যধারণ করতে পারেন। অন্যদিকে ট্রান্সজেন্ডারিজম নিশ্চিতভাবে একটি মনের অসুখ। এজন্য দরকার সঠিক কাউন্সিলিং ও আন্তরিক দুআ।

ইসলামের হুঁশিয়ারি

হাদীসে এসেছে, “রাসূল (সা) সেসকল পুরুষকে লানত করেছেন, যারা নারীর বেশ ধরে। আবার সেসকল নারীকে, যারা পুরুষের বেশ ধরে।”   (বুখারি, ৫৮৮৫)

ট্রান্সজেন্ডারিজমের ক্ষতি

১. সমাজে ব্যাপকভাবে বিকৃত যৌনতার প্রসার ও যৌন-নৈরাজ্য বিস্তারে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

২. কৌশলে সমকামিতার বৈধতা সৃষ্টি ও সমযৌনতার বাজারকে রমরমা করার বন্দোবস্ত করবে।

৩. নারীপুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক তথা বিয়ে নামক পবিত্র ও প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটাবে।

৪. উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে দেখা দেবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা।

৫. নারী কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার আবেদন বৃদ্ধি পাবে।

৬. তৈরি হবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি।

৭. আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।

করণীয়

ট্রান্সজেন্ডার ও অন্যান্য সকল প্রকাশ অশ্লীলতা-নির্লজ্জতা থেকে বেঁচে থাকার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে—

১. সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

২. সন্তানদের নৈতিক-শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।

৩. তারবিয়্যাহ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।

৪. যথাসময়ে বিবাহ-কে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। 

৫. নিরবিচ্ছিন্ন শিখন-প্রক্রিয়া (Continuous Learning Process) বজায় রাখতে হবে। 

৬. দ্বীনকে সামগ্রিকভাবে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে।

৭. সৎ সঙ্গ ও পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে ।

 প্রকৃতপক্ষে, মানবজীবনকে সফল এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে আল্লাহ-প্রদত্ত দ্বীনের পরিপূর্ণ অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক। সকলের উচিত, আল্লাহ তাআলার সমস্ত সিদ্ধান্তে পূর্ণ সন্তুষ্ট থেকে ইহকালীন মুক্তি ও পরকালীন কল্যাণ অর্জনে সদা সচেষ্ট থাকা। 

Related Articles