“তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাব, ৩৩:২১)
ব্যক্তির যাপিত জীবনকে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার জন্য রাসূল (সা)-এর মহান জীবনাদর্শের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণের বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল—সকল স্তরে তিনি মানবজাতির একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি যা নিয়ে এসেছেন, গোটা উম্মাহকে তা শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে হবে; আর যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে। আর এটি তখনই সম্ভবপর হবে, যখন নবিজির বিশাল-বিস্তৃত জীবনীর প্রতিটি মুহূর্ত সম্পর্কে উম্মাহর সঠিক জানাশোনা থাকবে। তাই এই উম্মাহকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে নবিজির প্রাত্যহিক জীবনবোধ, জীবনভাবনা ও জীবন পরিচালনার সামগ্রিক পদ্ধতি সম্পর্কে।
জেগে উঠতেন রাতের মধ্যভাগে
হাদীস বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধারণা করা যায়, প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাত প্রায় আড়াইটায় জেগে উঠতেন। উঠে তিনি এই দুআ পড়তেন—
الْحَمْدُ للَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
“প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি (নিদ্রারূপ) মৃত্যুর পর আমাদেরকে জীবিত করলেন, আর তাঁরই নিকট সকলের পুনরুত্থান।”
দুআ শেষ করে তিনি তিলাওয়াত করতেন সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত। এরপর মিসওয়াক ও অযু করে, বিগলিত হৃদয়ে মহান রবের সামনে তাহাজ্জুদে দাঁড়াতেন। দীর্ঘ দুই-তিন ঘণ্টা সময় ধরে আট রাকাআত তাহাজ্জুদ সালাতে নিমগ্ন থাকতেন—কখনো ঘরে, কখনো মসজিদে নববীতে।
রাতের এক-ষষ্ঠাংশ বাকি থাকতে, রাসূল (সা) উম্মুল মুমিনীনদেরকে জাগিয়ে দিতেন, যাতে তারাও তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতে পারেন। এরপর তাদেরকে সাথে নিয়ে নবিজি সালাতুল বিতর আদায় করতেন। কখনো কখনো এই সময়ে তিনি ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য অঝোর ধারায় কাঁদতেন আর কবরবাসীর জন্য দুআ করতেন। এরপর ঘরে ফিরে ফজরের আগ পর্যন্ত একটা ‘ন্যাপ’ (বা ছোট্ট ঘুম) নিতেন। বেলাল (রা.) আযান দিলে, আদায় করতেন ফজরের দু-রাকাআত সুন্নাত। অতঃপর মসজিদে গিয়ে ফরজ নামাজের ইমামতি করতেন।
ফজর শেষে যা করতেন
ফজরের সালাত শেষ করে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের দিকে মুখ করে তাকাতেন। তাসবীহ-তাহলিল পাঠ শেষে, সাহাবিদের উদ্দেশ করে জিজ্ঞেস করতেন :
هَلْ رَأَى أَحَدٌ مِنْكُمُ الْبَارِحَةَ رُؤْيَا؟
“তোমাদের কেউ কি গতরাতে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখেছো?”
সাহাবাগণ স্বপ্নের বর্ণনা দিলে, তিনি সেগুলোর উত্তম ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। সূর্য ওঠার পর আদায় করতেন চার রাকাআত সালাতুদ-দুহা। সালাত শেষে নবিজি বাড়িতে যেতেন। সালাম দিয়ে প্রবেশ করতেন ঘরে। এরপর পুনরায় মিসওয়াক করে, স্ত্রীদের সাথে কথাবার্তা বলতেন।
অধিক বরকত সকালে
নবিজি তাঁর স্ত্রীদের জিজ্ঞেস করতেন—‘খাওয়ার মতো কিছু আছে কি?’ খাবার থাকলে খেতেন, না-থাকলে রোজার নিয়ত করে ফেলতেন। রাসূল (সা) ফজরের পর না ঘুমিয়ে, সে-সময়টাতে বিভিন্ন কাজে সক্রিয় থাকতেন। পাশাপাশি তিনি চাইতেন, তাঁর উম্মাহও যেন ফজর-পরবর্তী সময়কে কাজে লাগায়। কেননা, এ-সময়টা অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। আর তাই, উম্মাহকে উৎসাহ প্রদানের জন্য তিনি দুআ করেছেন—“হে আল্লাহ! আমার উম্মাহর সকালের সময়কে বরকতময় করুন।”
চাই মসজিদভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো
প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বেরিয়ে আবারও মসজিদে নববীতে চলে যেতেন। আর আদায় করতেন দু-রাকাআত ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ সালাত। অতঃপর এখান থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংস্কারের সমস্ত কাজ আঞ্জাম দিতেন। আহলুস সুফফা-সহ সকল সাহাবাদেরকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নানামুখী উপদেশ প্রদান করতেন এই মসজিদে বসেই। অর্থাৎ শিক্ষা-দীক্ষা, ইবাদাত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ—সবকিছুই আবর্তিত হতো মসজিদকে কেন্দ্র করে।
দুপুরের আগে
সকাল এবং দুপুরের মাঝের সময়টুকুতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর নিতেন। মেয়ে ফাতিমা (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করতেন নাতিদের। তাঁদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতেন। তাঁদের সাথে সুন্দর সময় কাটাতেন।
মাঝে মাঝে এ সময়টায় রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাজার পরিদর্শনেও বের হতেন। বাজার ঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি-না, ব্যবসায়িক লেনদেনে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে কি-না, এসব বিষয় সরেজমিনে যাচাই করতেই তিনি বাজারে যেতেন।
কখনো কখনো এ-সময়টাতে উম্মুল মুমিনীনদের ঘরে মদীনার নারী ও মেয়েরা বিভিন্ন বিধানের ব্যাপারে প্রশ্ন নিয়ে এলে, তিনি সেসকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এ ছাড়া এ সময়টায় তিনি নিজ স্ত্রীদের গৃহস্থালির কাজেও সহযোগিতা করতেন। যেমন : জামা বা জুতা সেলাই করা, ছাগল বা উটের দুধ দোহন করা ইত্যাদি। প্রতি শনিবারে নবিজি মদীনা থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরের মসজিদে কুবায় যেতেন। সেখানে সালাত আদায় করতেন।
দুপুরের খাবার যখন খেতেন
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মতো যুহরের পর খাবার খেতেন না; বরং যুহরের আগে সবাইকে সাথে নিয়ে খাবার গ্রহণ করতেন। সাহাবাগণ কখনো তাঁকে খাবার হাদীয়া দিলে, তিনি তা সানন্দে গ্রহণ করতেন। নবিজি কখনোই খাবারের দোষ ধরতেন না। ভালো লাগলে খেতেন, নইলে এড়িয়ে যেতেন। খেজুর, দুধ, গোশত, রুটি, কালো জিরা, যায়তুন, ডালিম, কিশমিশ, মাশরুম, তীন, আঙ্গুর, সারীদ (গোশত ও রুটি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু খাবার), ছাতু, পনির প্রভৃতি খাবার রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে প্রিয় ও পছন্দনীয় ছিল।
নবিজি অল্প খাবার গ্রহণ করলেও, যতটুকু খেতেন, তাজা খেতেন। দুপুরের খাবার শেষে সামান্য বিশ্রাম গ্রহণ করতেন তিনি। এরপর চার রাকাআত সুন্নাত আদায় করে, যুহরের ফরজ নামাজ আদায় করতেন। নামাজের পর সাহাবিদেরকে নসীহত করতেন এবং তাঁদের কাজের তদারকি করতেন।
সোনালি বিকেলগুলো
সূর্য জ্বলজ্বলে থাকা অবস্থাতেই আসরের সময় হয়ে যেতো। আসরের নামাজ আদায় করে, তিনি পরিবারকে বিশেষভাবে সময় দিতেন। সে-সময়টাতে নবিজি থাকতেন খোশ-মেজাজে। তাঁর উম্মাহ হিসেবে প্রত্যেক মুসলিম পুরুষের উচিত—ছেলে-মেয়ে বা স্ত্রীদেরকে ‘কোয়ালিটি টাইম’ দেওয়া। তবে, মাঝেমধ্যে জরুরি প্রয়োজন পড়লে, এ-সময়ে রাসূল (সা) বাইরেও যেতেন।
সন্ধ্যার পরেই রাতের খাবার
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগরিবের সময় হলেই সালাত আদায় করে রাতের খাবার গ্রহণ করতেন। কখনোই দেরি করে খাবার গ্রহণ করতেন না তিনি। সুস্থ থাকার জন্য এটিই হলো শ্রেষ্ঠ খাদ্যাভ্যাস।
ইশার সালাতের পরে কথা নেই
সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নবিজি ইশা পড়তেন না। সাহাবায়ে কেরামের কথা ভেবে একটু আগে পড়তেন। একবার দেরি হয়ে গেলে তিনি বলেন, “এটিই ইশার উপযুক্ত সময়।” রাসূল (সা) ইশা পড়েই ঘুমিয়ে যেতেন। কোনো প্রকার কথাবার্তা বলতেন না। হাদীসে এসেছে—“রাসূল (সা) ইশার সালাতের আগে ঘুমানো এবং পরে কথাবার্তা বলা অপছন্দ করতেন।” (বুখারি, ৫৬৮)
এ-হাদীস প্রমাণ বহন করে, ইশার পরে ওয়াজ-মাহফিল, দরস-তাদরীস, মিটিং, অফিস ওয়ার্ক, পড়াশোনা, গল্পগুজব ইত্যাদি কোনোকিছু করাই উচিত নয়। হাদীস বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ-কথা বলা যায়—রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে ঘুমুতে যাওয়াই উত্তম।
প্রিয় নবির নিদ্রা
ঘুমানোর আগে রাসূল (সা) বিছানা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতেন, আর অযু করতেন। সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ার পর দু-হাতে ফুঁক দিয়ে পুরো শরীরে তা বুলিয়ে নিতেন। লম্বা দুআ শেষে ঘুমাবার আগে তিনি পড়তেন—
اَللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
“হে আল্লাহ! আপনার নামে মরে যাই, আবার আপনার নামেই জীবন লাভ করি।”
এরপর তিনি ডান কাতে শুয়ে পড়তেন। স্ত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ মেলামেলা করলে, কখনো কখনো গোসল করে ঘুমাতেন, কখনো আবার গোসল করতেন মাঝরাতে, তাহাজ্জুদের পূর্বে।
ডেইলি রুটিনের সারমর্ম
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রচণ্ড কর্মতৎপর একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন।
নবিজি খুব সাদামাঠা জীবন-যাপন করলেও, সেখানে ছিল রুচি ও আভিজাত্যের ছোঁয়া।
রাসূল (সা) তাঁর কর্ম, পরিবার, চিত্তবিনোদন, দেখা-সাক্ষাৎ, সভা-সমাবেশ ও ব্যক্তিগত জীবন—এ-সকল ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ সময়-ব্যবস্থাপনা (Time Management) নিশ্চিত করেছেন।
রাসূল (সা) তাঁর হৃদয়ে জীবিত-মৃত গোটা উম্মাহের প্রতি গভীর দরদ ও ভালোবাসা লালন করতেন।
প্রকৃতপক্ষে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর লাইফ-স্টাইলই হলো সর্বাপেক্ষা প্রোডাক্টিভ লাইফ-স্টাইল। ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সমৃদ্ধির জন্য প্রতিটি মুহূর্তে তাঁকে অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক। তাই সকলের উচিত, প্রতিনিয়ত একটু একটু করে নিজেদের জীবনকে তাঁর সুমহান জীবনের সাথে মিলিয়ে নেয়া।
Related Articles