পর্যায়ক্রমে সকল ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই || পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সৌজন্যবোধে তৈরি হোক ঐক্যের সেতু বন্ধন। কমে আসুক দূরত্ব। মজবুত হোক সম্প্রীতি।

Dr. Mizanur Rahman Azhari


mizan vai
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

বাংলাদেশ আয়তনে ছোট একটি দেশ হলেও, জনসংখ্যার দিক দিয়ে বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশের বিরাট একটি অংশ প্রত্যক্ষভাবে শ্রমনির্ভর পেশার সাথে সম্পৃক্ত। দেশ ও প্রবাসের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের অর্থ দিয়েই সচল থাকে দেশের অর্থনীতির চাকা। তাই, বাংলাদেশ সরকার-সহ সকল নাগরিকের উচিত এদেরকে সম্মান করা, তাদের অধিকারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। 

ইসলামে শ্রমের গুরুত্ব ও মর্যাদা

ইসলাম প্রতিটি মুহূর্তে উম্মাহকে কঠোর পরিশ্রমী হতে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে শুধু নামাজ-রোযা প্রভৃতি ইবাদাতে ব্যস্ত থাকতে বলেননি। বরং সালাত শেষে দ্রুত জমিনে ছড়িয়ে পড়ে, হালাল জীবিকা অন্বেষণ করতে বলেছেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে—

                فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.

“অতঃপর যখন সালাত শেষ হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।”   (সূরা জুমুআ, ৬২:১০)

পরিশ্রমের উপার্জন-ই শ্রেষ্ঠ

যুগে যুগে দুনিয়ার মহাপুরুষ আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম বিভিন্ন কর্ম ও পেশায় নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখেছেন। তারা কখনো কাজের মধ্যে বড়-ছোট তফাত করেননি। প্রিয় নবিজিও মজুরির বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল-ভেড়া চরিয়েছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন—

“আল্লাহ তাআলা এমন কোনো নবি প্রেরণ করেননি, যিনি বকরি চরাননি।” সাহাবিগণ বললেন, ‘আপনিও?’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ, আমিও কয়েক ক্বীরাত (বা মুদ্রার) বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরি চরাতাম।”   (বুখারি, ২২৬২)   

প্রেরণার বাতিঘর আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)

যেকোনো হালাল কাজকেই ছোট করে দেখবার কোনো সুযোগ নেই। তাই, কাজ করার মধ্যেও কোনো লজ্জা নেই। বরং লজ্জা হলো আলস্যে আর অকর্মণ্যতায়। সামান্য কাজ করে অথবা কাজ না করেই সফল হতে চাওয়া ভীরু ও দুর্বল মানসিকতার প্রকাশ ঘটায়। অথচ সফলতার জন্য কঠোর পরিশ্রম হলো পূর্বশর্ত। আরও সহজ করে বললে, সফলতা অর্জনের কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। সাফল্য-চূড়ায় আরোহণের জন্য পাড়ি দিতে হয় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের দীর্ঘ এক পথ। সোনালি যুগের সূর্য সন্তান—মহান সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই কঠোর পরিশ্রমের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত; মুসলিম উম্মাহর প্রেরণার বাতিঘর। তাদেরই একজন হলেন—জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)।

আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) হিজরত করে মক্কা ছেড়ে মদীনায় এসেছেন। প্রিয় নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মদীনার অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী সা’আদ ইবনে রবীআ (রা.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন। সা’আদ ইবনে রবীআ (রা.) আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমার অনেক ধন-সম্পত্তি আছে। আমি সেখান থেকে আপনাকে অর্ধেক ধন-সম্পত্তি দিয়ে দিতে চাই। এ ছাড়া আমার একাধিক স্ত্রীও আছে। এদের মধ্যে কাউকে যদি আপনার পছন্দ হয়, আর সে-ও যদি আপনাকে পছন্দ করে, তবে তাকে আমি আপনার জন্য তালাক দিয়ে দিতে চাই।’

আব্দুর রহমান ইবনে আউফ তাঁর আনসারী ভাইয়ের কথা শুনে সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ হলেন। তাঁর জন্য বরকতের দুআ করলেন। তবে, তিনি সা’দ ইবনে রবীআ’র এই মোহনীয় প্রস্তাব বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিলেন। আর জিজ্ঞেস করলেন—‘বেচা-কেনার জন্য আশেপাশে কোনো বাজার পাওয়া যাবে কি?’

অতঃপর আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বাজারে গিয়ে কিছু ঘি ও পনির কিনলেন। এরপর বিক্রি করলেন সেগুলো। পুনরায় কিছু ঘি ও পনির ক্রয় করলেন। আবার সেগুলো অধিক লাভে বিক্রি করলেন। এভাবে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি মদীনায় অত্যন্ত সফল একজন ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়—আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা) ‘রেডি-মেইড’ ক্যারিয়ার বেছে নেননি। বরং আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজের পথ করে নিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, নিজ পরিশ্রমে অর্জিত সফলতার চেয়ে বড় সফলতা আর নেই। যুব সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের প্রত্যেকেই এখান থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার প্রেরণা ও উৎসাহ গ্রহণ করতে পারেন।

পানাহ চাইতেন দারিদ্র্য থেকে

দরিদ্রতা বড্ড ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা। এটি বান্দার আমল বিনষ্ট করে দেয়। কখনো কখনো ধ্বংস করে দেয় ঈমানও। এজন্য নবিজি আমাদেরকে দুআ শিখিয়েছেন—

                                                                               ‏اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ.

“হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অস্বচ্ছলতা, স্বল্পতা ও অপমান-অপদস্থতা হতে আশ্রয় প্রার্থনা করি।”

এ-দুআটি সকলের বেশি বেশি পড়া দরকার এবং এর অন্তর্নিহিত আবেদন—কঠোর পরিশ্রম—এর ব্যাপারে আরও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

ভিক্ষাবৃত্তি নয়; চাই উপযুক্ত কর্মসংস্থান

বৈধ কাজের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয়  কাজ হলো ভিক্ষাবৃত্তি। নবিজি সব সময় এটিকে অনুৎসাহিত করতেন। জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাছে হাত পাতলে, তিনি তাকে একটি কুঠারের ব্যবস্থা করে দেন। আর জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহের পরামর্শ প্রদান করেন।

ইসলাম কর্মমুখী ধর্ম

প্রিয় নবির বৃক্ষরোপণের একটি হাদীস—যা মানবজাতিকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কর্মোদ্যমী হবার প্রেরণা জোগায়। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

“যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ মুহূর্তেও তোমাদের কারও হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তা হলে সে যেন তা রোপণ করে দেয়।”   (মুসনাদ আহমাদ, ১২৯০২)   

ইসলামে শ্রমিকের অধিকার

পবিত্র ধর্ম ইসলাম শ্রমিকের সকল প্রকার অধিকার নিশ্চিত করেছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি অধিকারের ওপর আলোকপাত করা হলো।

১. পারিশ্রমিকের অধিকার :

মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বা পারিশ্রমিক দিয়ে কখনোই করুণা করেন না; বরং এটি শ্রমিকের অধিকার। নবিজি বলেছেন—“ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।”   (সুনান ইবনে মাজাহ, ২৪৪৩)   

রাসূল (সা) কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিপক্ষে থাকবেন। তার মধ্যে একজন হলো সে, যে কাউকে শ্রমিক নিয়োগ দেয়ার পর তার থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে, অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি।

২. চুক্তিমাফিক সকল সুবিধাপ্রাপ্তির অধিকার :

মালিকপক্ষকে অবশ্যই নিয়োগ-চুক্তি পূরণ করতে হবে। কর্ম, কর্মঘণ্টা, বেতন, ওভার-টাইম, ব্রেক টাইম, সাপ্তাহিক ও বাৎসরিক ছুটি প্রভৃতি বিষয়ে—চুক্তি-অনুযায়ী শ্রমিকের প্রাপ্য যথাযথভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে কি-না, সে-ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

শ্রমিকগণের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকপক্ষের দায়িত্ব। মালিকপক্ষ নিজেদের মর্জিমাফিক হুট করে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করবে কিংবা উপযুক্ত কারণ ছাড়া চাকরি ছাড়ার নোটিশ দেবে—এটা মানবতাবিরোধী। তাই, শ্রমিকগণ যাতে নিশ্চিন্তমনে চাকরি করতে পারেন, এ ব্যাপারে নিয়োগকারী সংস্থাকে যথেষ্ট আন্তরিক হতে হবে। একই সাথে শ্রমিকগণ অসুবিধার কারণে চাকরি ছাড়তে চাইলে, সে-সুযোগও তাদেরকে দিতে হবে।

৩. সুন্দর আচরণ পাওয়ার অধিকার :

শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নিছক প্রভু ও ভৃত্যের মতো নয়। বরং নবিজি এই সম্পর্ককে ‘ভাই-ভাই সম্পর্ক’ বলে অভিহিত করেছেন। রাসূল (সা) বলেন, “যারা তোমাদের কাজ করছে, তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন।” 

৪. নিরাপত্তার অধিকার :

কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি একটি বিষয়। ক্যামিকেল-সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মাস্ক-গ্লাভস সরবরাহ করতে হবে। নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জামাদির। এ ছাড়া প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকতে হবে।

৫. সাধ্যাতীত কর্ম চাপানো যাবে না :

মালিকপক্ষ সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ শ্রমিকের ওপর চাপিয়ে দেবে না। যদি অতিরিক্ত বা সাধ্যাতীত কোনো কাজ করাতে হয়, তবে সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করতে হবে এবং অতিরিক্ত পারিশ্রমিকও প্রদান করতে হবে।

৬. ফরজ হুকুম পালনের অধিকার :

প্রতিদিনের ফরজ সালাত, রমজান মাসে রোজা রাখা, নারীদের হিজাব পরিধান, পুরুষদের দাড়ি রাখা ও হালাল-খাবার জোগানের মতো বিষয়গুলো একজন মুসলিমের ওপর আবশ্যক। মুসলিম শ্রমিকদেরকে এসকল ধর্মীয় বিধান পালনের অধিকার প্রদান করতে হবে।

৭. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার :

‘শ্রম’ই শ্রমিকগণের একমাত্র পুঁজি। শ্রমিক বৃদ্ধ বা অসুস্থ হয়ে পড়লে, তার জীবিকা নির্বাহের কোন পথই থাকে না। শ্রমজীবী ব্যক্তিরা স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সাফল্যে ভূমিকা রাখতে গিয়ে, যৌবনের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করে, শেষ বয়সে হয়ে পড়েন নিঃস্ব ও রিক্ত। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষ এসকল শ্রমিকদের দুর্দশার খবর রাখেন না। তবে করণীয় হলো—বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ ও অক্ষম হয়ে পড়া শ্রমিকদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব মালিকপক্ষ নেবেন। এক্ষেত্রে, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ‘শ্রমিক/কর্মী উন্নয়ন তহবিল’ গড়ে তোলা যায়। উক্ত তহবিল গঠনে মালিকপক্ষের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে—একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের অনুদান নিয়ে। এ ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যেসকল শ্রমিক কাজ করেন, তাদের জন্যও সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রয়োজন অনুপাতে ন্যূনতম ভাতা নির্ধারণ এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সরকার-মালিকপক্ষের বাইরেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী বা ওয়াকফ্‌ সংগঠন শ্রমিকদের বৃহত্তর কল্যাণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে।

শ্রমিকের প্রতি মালিকের অধিকার :

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-বিধান। শ্রমিকের পাশাপাশি মালিকপক্ষেরও যথার্থ অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। শ্রমিকের প্রতি মালিকের কয়েকটি অধিকার এখানে তুলে ধরা হলো :

১. শ্রমিক তার প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতা বজায় রাখবে।

২. তিনি চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে যথার্থ শ্রম দেবেন।

৩. সাধ্যের সবটুকু দিয়ে কাজ করবেন।

৪. সবটুকু আন্তরিকতা মিশিয়ে কাজ করবেন।

Related Articles