পৃথিবীতে সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ আল্লাহর কাছে যা কিছু চায়, রিয্ক তার মধ্যে অন্যতম। ব্যক্তিজীবনে প্রায় সকলেই নিজের ও আপনজনদের জন্য উত্তম ও কল্যাণকর রিয্কের প্রার্থনা করেন। তবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ রিয্কের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ ধারণা রাখেন না। বস্তুত, জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে রিয্ক সম্পর্কে যথাযথ ধারণা লাভ করা অপরিহার্য।
রিয্ক কী?
রিয্ক-এর বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘জীবনোপকরণ’। অর্থাৎ জীবন পরিচালনায় মানুষের যা যা প্রয়োজন কিংবা পুরো জীবন জুড়ে মানুষ যা কিছু অর্জন করে, তার সবটাই রিয্ক।
রিয্কের স্তরসমূহ:
সর্বনিম্ন স্তর : খাদ্য-বস্ত্র, অর্থ এবং অন্যান্য জাগতিক সম্পদ। জীবনে টিকে থাকার জন্য এগুলো প্রয়োজন। বুদ্ধিমান মানুষেরা এগুলোর জন্য ঠিক ততটুকুই চেষ্টা-সাধনা করে, যতটুকু তার না হলেই নয়।
সর্বোচ্চ স্তর : শারীরিক-মানসিক উভয় দিক থেকে সুস্থ বা ফিট থাকাই হলো রিয্কের সর্বোচ্চ স্তর।
সর্বোত্তম স্তর : রিয্কের এই স্তরে আছে পুণ্যবান জীবনসঙ্গী ও পরিশুদ্ধ নেক সন্তান। কারো জীবনসঙ্গী এবং সন্তান-সন্ততি যদি নেককার ও ধার্মিক হয়, তা হলে তার ঘরটিই হবে জান্নাতের একটি টুকরো। খাদিজা (রা.)-এর মমতা, ভালোবাসা ও সহযোগিতাকে রাসূল (সা) নিজের জন্য রিয্ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
পরিপূর্ণ স্তর : রিদাল্লাহ বা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। মানবজীবনে এটিই হলো সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষিত বিষয়।
প্রশস্ত স্তর : রিয্কের সবচেয়ে প্রশস্ত স্তর হলো ধৈর্য। জীবনে সফলতা লাভের ক্ষেত্রে অস্থিরতা পরিহার করা অপরিহার্য। রাসূল (সা) বলেছেন :
“কোনো বান্দাকে তার জন্য ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও বিস্তৃত কিছু দেয়া হয়নি।” (ইমাম আল-হাকিম, আল-মুসতাদরাক, ৩৫৫২)
কল্যাণকর স্তর : রিয্কের কল্যাণকর স্তর হচ্ছে হিকমাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
“তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়। আর বিবেকসম্পন্নরাই উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা বাকারা, ২:২৬৯)
রিয্কের ব্যবস্থাপক আল্লাহ তাআলা
“আর যমীনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিয্কের দায়িত্ব আল্লাহ তাআলারই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। সবকিছু আছে স্পষ্ট কিতাবে।” (সূরা হূদ, ১১:৬)
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে নিজের পরিচয় দিয়েছেন—‘রাযযাক’ বা ‘রিয্কদাতা’ হিসেবে।
إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ
“তিনিই তো রিয্কদাতা; প্রবল শক্তিধর, পরাক্রমশালী।” (সূরা যারিয়াত, ৫১:৫৮)
আল্লাহ তাআলা প্রতিনিয়ত পুরো বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর আহার জুগিয়ে যাচ্ছেন। এতে তাঁর অঢেল ধনভান্ডারের সামান্যতম অংশও হ্রাস পাচ্ছে না। আবার, তিনি কোনো প্রাণীকে রিয্ক দিতে ভুলেও যান না। বাধ্য-আবাধ্য সবাইকে পরম করুণায় অবারিত রিয্ক প্রদান করছেন। এ-সবকিছুর আঞ্জাম দিতে পারেন বলে কেবল আল্লাহ তাআলা-ই ‘রাযযাক’। আর কারো পক্ষে ‘রাযযাক’ হওয়া সম্ভব নয়।
রিয্ক—বান্দার পরীক্ষা
কখনো অঢেল রিয্ক দিয়ে, আবার কখনো রিয্কের সংকীর্ণতায় ফেলে আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষা করেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে—
“আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন রিয্ক বাড়িয়ে দেন এবং সঙ্কুচিত করেন। আর তারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে মেতে আছে, অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন খুবই নগণ্য।” (সূরা রা’দ, ১৩:২৬)
ফায়সালা হয়ে যায় মায়ের পেটেই
মুমিন কখনো রিয্ক নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয় না। কেননা, মাতৃগর্ভে থাকতেই তার রিয্ক নির্ধারিত হয়ে যায়। হাদীসে এসেছে :
তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি (শুক্রাণু) তার মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন জমাট থাকে। এরপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে তা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়। এরপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে তা একটি মাংসপিণ্ডে রূপ নেয়। এরপর আল্লাহ তাআলার তরফ থেকে একজন ফেরেশতা পাঠানো হয়। তিনি তাতে (অর্থাৎ মাংসপিণ্ডে) রুহ ফুঁকে দেন। আর তাঁকে চারটি বিষয় লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়—বান্দার রিয্ক, মৃত্যুক্ষণ, কর্ম এবং তার বদকার ও নেককার হওয়া। (বুখারি, ৬৫৯৪; মুসলিম, ২৬৪৩)
রিয্ক ভোগ করা ছাড়া মৃত্যু নেই
ব্যক্তির তাকদীরে যতটুকু রিয্ক লিখিত, ততটুকু তিনি ভোগ করবেনই। কোনো ফল যদি তিনি খান, তা হলে বুঝতে হবে—এই ফলটি তার রিয্কেরই অংশ। অনেকেই এই ফলটি দেখেছে, ধরেছে, কিন্তু খায়নি। কারণ, ফলটি এই ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত; তিনি এটা ভোগ না করে মারা যাবেন না। এটাই হচ্ছে রিয্কের সারকথা।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
لا تَموتُ نفسٌ حتى تسْتكمِلَ رِزْقَهَا.
“কোনো প্রাণী তার জীবিকা পূরণ না করা পর্যন্ত মারা যাবে না।” (ইবনু মাজাহ, ২১৪৪)
হালাল নাকি হারাম—সিদ্ধান্ত বান্দার
রিয্ক পূর্বনির্ধারিত হলেও তা কোন পথে অর্জিত হবে—সে-সিদ্ধান্ত বান্দার। ধরা যাক, কোনো বান্দার তাকদীরে লিখিত—সে সারাজীবনে একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয় করবে। সৎপথে চেষ্টা, ধৈর্যধারণ ও আল্লাহর কাছে দুআর মাধ্যমে সে হালাল উপায়ে এই অর্থ পেতে পারে। আবার চাইলে অসৎ উপায় অবলম্বন করেও তা কুক্ষিগত করতে পারে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে স্বাধীন সত্ত্বা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এবার সিদ্ধান্ত মানুষের—সে হালাল পথে ইনকাম করবে, নাকি হারাম পন্থায়। যেভাবেই করুক না কেন, তার নির্ধারিত অংশই সে পাবে; এর বেশিও না, কমও না।
কেউ কারো রিয্কে ভাগ বসায় না
প্রত্যেকে তার নিজের রিয্কের অংশই পাচ্ছে। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব বা কোনো মেহমান বাসায় এসে খাবার খেলে, তিনি মেজবানের (Host) রিয্ক খাচ্ছেন না। এটা বরং তারই রিয্ক। আল্লাহ মেজবানের মাধ্যমে শুধু সেটা মেহমানের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘একদিন আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, “হে যুবক! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি—তুমি আল্লাহ তাআলার (বিধি-নিষেধ) রক্ষা করবে, আল্লাহ তাআলা তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ তাআলাকে তুমি কাছে পাবে। তোমার কোনোকিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে, আল্লাহর নিকট চাও। আর সাহায্য প্রার্থনা করতে হলে, আল্লাহর কাছেই করো। জেনে রেখো, সমস্ত মানুষ যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা ব্যতীত আর কোনো উপকার করতে পারবে না। আর যদি সমস্ত মানুষ তোমার কোনো অনিষ্ট করতে চায়, তবে আল্লাহ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা ব্যতীত আর কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠা শুকিয়ে গেছে।”’ (তিরমিজি, ২৫১৬)
রিয্কের বারাকা কোন পথে?
গোটা উম্মাহ চায়, তাদের রিয্কে আসমানী বারাকাহ নেমে আসুক। আর এই বারাকাহ পেতে হলে প্রয়োজন—আসমানী নির্দেশনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনার ওপর আলোকপাত করা হলো।
আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা :
আল্লাহর ওপর ভরসা করার সুন্দর এক উপমা হাদীসে বিধৃত হয়েছে এভাবে—
“যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথার্থ ভরসা করো, তা হলে তিনি তোমাদের অনুরূপ রিয্ক দান করবেন, যেরূপ পাখিকে রিয্ক দিয়ে থাকেন। তারা ভোরে খালি পেটে বের হয় এবং দিনের শেষে ভরা পেটে (নীড়ে) ফিরে আসে।” (তিরমিজি, ২৩৪৪; ইবনু মাজাহ, ৪১৬৪)
আল্লাহ-ভীতি :
পুরো কুরআন মাজীদের মূল শিক্ষা হলো আল্লাহভীতি। যারা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পেরেছে, তাদের রিয্ক নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। কল্পনাতীতভাবে আল্লাহ তাদের রিয্কের ব্যবস্থা করবেন। কুরআন কারীমে এসেছে—
“আর যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ করে দিবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রুজি দান করবেন।” (সূরা তালাক, ৬৫:২-৩)
সালাত :
সালাত আল্লাহ তাআলার কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় ইবাদাত। সালাতের মাধ্যমেই বান্দা তার মনিবের নৈকট্য লাভ করতে পারে। আর আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দারা তাঁর অনুগ্রহে রিয্কে বারাকাহ লাভ করে থাকেন।
ইস্তিগফার :
পৃথিবীতে চলার পথে সবারই কম-বেশি ভুল ও গুনাহ হয়ে থাকে। তাই, আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। রাসূল (সা) দৈনিক ইস্তিগফার পাঠ করেছেন। পড়েছেন সায়্যিদুল ইস্তেগফার। প্রত্যেকেরই উচিত, আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা। তা হলে অবশ্যই সকলের সামগ্রিক রিয্কে বারাকা নেমে আসবে, ইন শা আল্লাহ।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা :
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা মুমিনের একটি বড় গুণ। এই গুণটি জীবনে যত বেশি চর্চা করা যাবে, রিয্কে তত বেশি বারাকাহ আসবে। রাসূল (সা) বলেন :
“যে ব্যক্তি চায় যে, তার রুজি (জীবিকা) প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি পাক, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখে।” (বুখারি, ৫৯৮৬; আবু দাউদ, ১৬৯৩)
অধিক দান-সদাকা :
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজীদে বলেন—
“আর তোমরা আল্লাহর জন্য যা কিছু ব্যয় করো, তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিয্কদাতা।” (সূরা সাবা, ৩৪:৩৯)
চাইতে হবে রবের কাছে :
নবি-রাসূলগণও আল্লাহ তাআলার কাছে উত্তম রিয্ক কামনা করতেন। কুরআন কারীমে ইবরাহীম (আ)-এর একটি চমৎকার দুআ উঠে এসেছে—
“আর স্মরণ করো, যখন ইবরাহীম বলল, ‘হে আমার রব, আপনি একে নিরাপদ নগরী বানান, আর এর অধিবাসীদেরকে ফলমূলের রিয্ক দিন যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান এনেছে।’”
দুআ করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, শুধু দুআ করলেই রিয্কের ফায়সালা হয়ে যায় না। সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহ তাআলাই রিয্কের একমাত্র ব্যবস্থাপক। তবে, বান্দার করণীয় হলো, সঠিক-সুষ্ঠু পন্থায় রিয্ক অন্বেষণ করা।
পরিশেষে বলা যায়, রিয্ক একটি বিস্তৃত বিষয়ের নাম। পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার ওপর পূর্ণ ভরসা করে হালাল রিয্ক অন্বেষণের সবগুলো পথে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করাই মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা সমগ্র উম্মাহকে সঠিক পরিকল্পনা ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বরকতপূর্ণ রিয্কের অধিকারী করুন। আমিন।
Related Articles