মহান আল্লাহ তাআলা অসংখ্য নিয়ামত দিয়ে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে ধন্য করেছেন। গোটা পৃথিবীময় অগণিত অনুগ্রহ ছড়িয়ে রাখার পাশাপাশি মানুষের সাড়ে তিন হাত দেহের মাঝেও তিনি দিয়ে রেখেছেন অজস্র নিয়ামত। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ هُوَ الَّذِي أَنشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ ۖ قَلِيلًا مَّا تَشْكُرُونَ
“(হে নবী) বলুন, ‘তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও বিচারবুদ্ধি। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা আদায় করো।” (সূরা মুলক, ৬৭:২৩)
বিচারবুদ্ধি বা বিবেকবুদ্ধি আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় নিয়ামত। চিন্তাশক্তি ও বিবেক প্রয়োগের জন্য আল্লাহ তাআলা মানুষকে অনন্যসাধারণ মস্তিষ্ক দিয়েছেন। আর এর প্রভাবেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা।
মানব মস্তিষ্ক
একজন পরিণত মানুষের ব্রেইনের ওজন ৩ পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় দেড় কেজি। আর এর স্মৃতিধারণ ক্ষমতা ২.৫ পেটাবাইট বা ২.৫ মিলিয়ন গিগাবাইট! অর্থাৎ একজন পরিণত মানুষ তার মস্তিষ্কে ২৫ লক্ষ জিবি পরিমাণ তথ্য ধারণ করতে পারেন। এসকল তথ্য সঞ্চালন ও সংরক্ষণের জন্য মানব মস্তিষ্কে ৮৬০০ কোটি নিউরন রয়েছে। (Herculano-Houzel, 2009). এ ছাড়া মস্তিষ্কে যেসকল রক্ত-সঞ্চালক শিরা আছে, তা প্রায় ৪০০ মাইল লম্বা দূরত্বের সমান! (Sweeney et al., 2019).
চারটি শব্দ
মানুষ যেন মাথা খাটায়, চিন্তাশক্তির চর্চা করে—এ ব্যাপারে কুরআন মাজীদে অসংখ্য নির্দেশনা এসেছে। সবগুলো আয়াত পর্যবেক্ষণ করলে এ-ব্যাপারে চারটি মৌলিক শব্দ পাওয়া যায়—
১. নজর (النظر), ২. আকল (العقل), ৩. তাফাক্কুর (التفكر) ও ৪. তাদাব্বুর (التدبر) ।
চাই সুগভীর দৃষ্টি :
আল্লাহ তাআলা এ বিশ্বজগতকে সুগভীর দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান করেছেন। পবিত্র কুরআন কারীমে এসেছে—
“তবে কি তারা তাকিয়ে দেখে না উটের দিকে, কীভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? আসমানের দিকে, কীভাবে তা ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে? পর্বতমালার দিকে, কীভাবে তা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে? আর ভূতলের দিকে, কীভাবে তা বিস্তৃত করা হয়েছে?” (সূরা গাশিয়া, ৮৮:১৭-২০)
বিস্ময়কর উট
উট আল্লাহ তাআলার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। উটের গোশত খাওয়া যায়, দুধ পান করা যায়। এর চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয় মূল্যবান সব সামগ্রী। ধূ-ধূ মরুভূমিতে যাত্রী বা পণ্য পরিবহণে উটের মতো নির্ভরযোগ্য ‘বাহন’ পাওয়া অসম্ভব। এটি এমন এক প্রাণী, যা মরুভূমির প্রতিকূলতায় কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত অতি অল্প পানি ও খাবারে বেঁচে থাকতে পারে। আবার একসাথে ২০০ লিটার পানিও পান করতে পারে। একটি উট ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা অনায়াসে সহ্য করতে পারে। এ ছাড়া উট মরুভূমির ক্যাকটাস-সহ সকল কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদ খেতে সক্ষম। প্রাণীটির এসকল বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তাআলার নিপুণ সৃষ্টিশীলতার-ই বহিঃপ্রকাশ।
সুনীল আকাশ
সুনীল আকাশ আল্লাহ তাআলার আরেক বিস্ময়কর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন—
“নিশ্চয়ই আমি নিকটবর্তী আসমানকে তারকারাজির সৌন্দর্যে সুশোভিত করেছি।” (সূরা সাফফাত, ৩৭:৬)
আকাশে যে সূর্য দেখা যায়, সেটি একটি তারা এবং তা আয়তনে পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। তবে, মহাবিশ্বে এমন সব তারাও আছে, যেগুলো সূর্যের চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বড়। সে-রকম প্রায় ১০০ বিলিয়ন থেকে ৪০০ বিলিয়ন তারা নিয়ে গঠিত হয় একটি গ্যালাক্সি। আবার, এরকম শত শত বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে, যাকে কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে ‘আস-সামা উদ-দুনিয়া’। যদি এই আকাশকে একটি মানচিত্রে রূপ দেওয়া হয়, তবে তার তুলনায় পৃথিবী এতটাই ক্ষুদ্র যে, মাইক্রোস্কোপ দিয়েও তা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
পাহাড়
পৃথিবীকে স্থিতিশীল রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা দেশে দেশে অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড় তৈরি করেছেন। উত্তর আমেরিকার আলাস্কা রেঞ্জ প্রায় ৯৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ। ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘতম পাহাড় হলো আল্পস পর্বতমালা—প্রায় ১২০০ কিলোমিটার! সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ এভারেস্টের উচ্চতা ২৯,০৩১.৭ ফিট বা ৮৮৪৮.৮৬ মিটার। আল্লাহ তাআলা এগুলোর ব্যাপারে বলেন :
“পর্বতসমূহ সৃষ্টি করেছি পেরেকস্বরূপ।” (সূরা নাবা, ৭৮:৭)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, পাহাড়ের যেটুকু অংশ দৃশ্যমান, তা আদতে পাহাড়ের বহিঃঅংশ মাত্র; এর মূল অংশটাই হলো মৃত্তিকা গহ্বরে। ঠিক যেমনি করে পেরেকের মাথা কাঠের ওপরে দৃশ্যমান, আর বাকি অংশ কাঠের অভ্যন্তরে গেঁথে থাকে।
যমীন
আল্লাহ তাআলা এ ভূপৃষ্ঠকে বিভিন্ন স্তরে স্তরে সাজিয়েছেন। পৃথিবীর উপরিভাগে রয়েছে উর্বর মাটি—যেখানে বীজ রোপণ করলে উদ্ভিদ ও ফসল জন্মায়। এর গহ্বরে বিভিন্ন শিলা ও খনিজ স্তর রয়েছে। যেমন : আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা ও রূপান্তরিত শিলা। এসকল শিলাই পৃথিবীর বহিরাবরণ গঠন করে। আর এগুলোর নিচে রয়েছে আরও ঘন ও গাঢ় স্তর—ম্যান্টল ও কোর।
চাই অনুধাবন ক্ষমতা :
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বিবেকবানদেরকে উদ্দেশ করে বলেছেন—
“মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি, রাত ও দিনের আবর্তন, মানুষের উপকারী জিনিস নিয়ে সমুদ্রে ছুটে-চলা জাহাজ, আকাশ থেকে আল্লাহর বর্ষণ-করা পানি—যা দিয়ে তিনি জমিন নিষ্প্রাণ হয়ে যাওয়ার পর তাতে প্রাণ-সঞ্চার করেন এবং তাতে সব ধরনের জীবজন্তুর বিস্তার ঘটান—বায়প্রবাহ, আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে অনুগত মেঘমালা—এই সবকিছুর মধ্যে সেসব লোকের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে, যারা বিবেকবুদ্ধি কাজে লাগায়।” (সূরা বাকারা, ২:১৬৪)
তাই সকলের উচিত, সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই আল্লাহ তাআলার এসব নির্দশন নিয়ে ভাবা; এগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করা। কেননা, সময় ফুরিয়ে গেলে এসব নিয়ে ভাবলে সামান্যতম লাভও হবে না। কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসীরা আফসোস করে বলবে—
“যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক খাটাতাম, তাহলে আমরা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।” (সূরা মুলক, ৬৭:১০)
চিন্তাশক্তির চর্চা :
তাফাক্কুর তথা চিন্তাশক্তি চর্চা করার ক্ষেত্রে ইবরাহীম (আ) মানবজাতির জন্য অনুপম উদাহরণ। তিনি অন্যান্যদের মতো চাঁদ, তারা বা সূর্যপূজার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, আল্লাহর দেওয়া চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর চিন্তাশক্তির ব্যাপারে কুরআন কারীমে এসেছে—
“রাতের অন্ধকার তাকে আচ্ছন্ন করে নিলে সে একটি তারা দেখতে পায়। সে বলে, ‘(তাদের কথামতো) এটি আমার রব!’ সেটি একপর্যায়ে হারিয়ে গেলে সে বলে, ‘যারা হারিয়ে যায়, আমি তাদেরকে পছন্দ করি না।’ এরপর চাঁদ উঠতে দেখে সে বলে, ‘(তাদের কথামতো) এটি আমার রব!’ একপর্যায়ে সেটিও অদৃশ্য হয়ে গেলে সে বলে, ‘আমার রব আমাকে পথ না দেখালে আমি তো পথহারা লোকদের দলে শামিল হয়ে যাব!’ এরপর সূর্য উঠতে দেখে সে বলে, ‘(তাদের কথামতো) এটি আমার রব! এটা সবচেয়ে বড়।’ একপর্যায়ে সেটাও উধাও হয়ে গেলে সে বলে, ‘ও আমার জাতি, তোমরা যেসব শির্ক করো, সেগুলোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।” (সূরা আনআম, ৬:৭৬-৭৮)
ইবরাহীম (আ) পৃথিবীর এই বিশাল সৃষ্টিগুলোর সীমাবদ্ধতা অনুধাবনের পর এক আল্লাহ তাআলার ইবাদতেই স্থির হলেন। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন :
“আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফেরাচ্ছি, যিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (সূরা আনআম, ৬:৭৯)
কুরআন মাজীদের অপর আয়াতে এসেছে—
“তোমার রব মৌমাছির কাছে এই নির্দেশনা পাঠান : ‘পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ও মানুষের বানানো স্থাপনাগুলোতে ঘর বানাও, তারপর সব-ধরনের ফল থেকে খাও, আর তোমার রবের পথে অনুগত হয়ে চলো!’ মৌমাছির পেট থেকে বেরিয়ে আসে নানা রঙের পানীয়, যাতে রয়েছে মানুষের (বিভিন্ন রোগব্যাধির) উপশম। এর মধ্যে সেসব লোকের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে, যারা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে।” (সূরা নাহল, ১৬:৬৮-৬৯)
কুরআন কারীমের অপর আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে—
“নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে জ্ঞানী লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং (বলে) ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র। তুমি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০-১৯১)
পবিত্র কুরআন কারীমের এ আয়াতগুলো মানুষকে বারবার মাথা খাটাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় এনে মুসলিম উম্মাহর উচিত, আল্লাহর দেওয়া মেধা কাজে লাগিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বকে বিশ্বজগতে প্রমাণ করা।
ভাবতে হবে কুরআনি ঘটনাবলি
পবিত্র কুরআনের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে নবি-রাসূলদের পাশাপাশি অন্যান্যদের অসংখ্য ঘটনাবলি বিধৃত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মানবজাতির মন-মনন উন্নয়নের জন্য তাদাব্বুর তথা কুরআনি ঘটনাবলি নিয়ে ভাবার বিকল্প নেই। কুরআন মাজীদের প্রতিটি আয়াত তিলাওয়াতের পাশাপাশি সেগুলোর মর্মার্থ উদ্ধার করা জ্ঞান ও বিচক্ষণতার দাবি। কুরআন কারীমে এ-ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো :
“তবে কি তারা কুরআন মাজীদ নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?” (সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭:২৪)
“তারা কি কুরআন মাজীদ নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হতো, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরিত্ব দেখতে পেত।” (সূরা নিসা, ৪:৮২)
“আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা সোয়াদ, ৩৮:২৯)
মহান আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে যে এত এত নিয়ামত দিলেন, এগুলোর সদ্ব্যবহার না করলে, একদিন এজন্যও সকলকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
“তারপর সেদিন অবশ্যই তোমরা নিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (সূরা তাকাসুর, ১০২:৮)
কুরআন মাজীদ নাযিলের আগে থেকেই হেরা গুহায় বসে রাসূল (সা) তাঁর চিন্তাশক্তিকে শতভাগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরেও এই চিন্তা-গবেষণা নিয়ে বহু নির্দেশনা এসেছে। তাই উম্মাহর করণীয়—কুরআন জেনে, কুরআন বুঝে এবং কুরআনের আলোকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পৃথিবীতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন করা।
Related Articles