পর্যায়ক্রমে সকল ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই || পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সৌজন্যবোধে তৈরি হোক ঐক্যের সেতু বন্ধন। কমে আসুক দূরত্ব। মজবুত হোক সম্প্রীতি।

Dr. Mizanur Rahman Azhari


mizan vai
সুখী হওয়ার উপায়সমূহ

পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তিই দুঃখী হতে চায় না। তাইতো, সুখী হওয়ার জন্যই সকলের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অবিরাম চলছে। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীতে সুখী হওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। সুখী হওয়ার নিয়মগুলো জেনে সে-অনুযায়ী অগ্রসর হতে পারলে, সুখী হওয়াটা অনেক সহজ।

চাই অনন্ত সুখ

আখিরাতের সুখ-ই হলো অনন্ত সুখ। এখানে জান্নাতবাসীরা যে সুখের দেখা পাবেন, তা কখনো শেষ হবে না। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন : 

وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۖ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ 

“আর যারা ভাগ্যবান হয়েছে, তারা জান্নাতে থাকবে, সেখানে তারা স্থায়ী হবে যতদিন পর্যন্ত আসমানসমূহ ও যমিন থাকবে, যদি না তোমার রব ভিন্ন কোনো ইচ্ছা পোষণ করেন। এটি হলো এক অফুরন্ত পুরস্কার।”   (সূরা হুদ, ১১:১০৮)

আখিরাতের অনন্ত সুখ কেমন হবে অথবা সেই সুখের জন্যই মানুষের সার্বক্ষণিক কর্মব্যস্ততা থাকা উচিত—এমন বোধ সৃষ্টির জন্য আল্লাহ তাআলা মানুষকে পার্থিব জীবনে কিছুটা সুখভোগ করবার সুযোগ দেন। পরবর্তীতে মুমিনরা জান্নাতে গিয়ে দুনিয়ার জীবনের স্মৃতিচারণ করবেন। কুরআনে এই বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে—

“তাদেরকে যখন ফল-মূল দেওয়া হবে, তারা বলবে একই রকম ফল-মূল তো আমাদেরকে পূর্বেও (দুনিয়াতে) দেয়া হয়েছিল।”   (সূরা বাকারা, ২:২৫)

সাধারণত্বেই আভিজাত্য

জীবন সহজ করলে সহজ, কঠিন করলে কঠিন। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দার সব কিছুতে সহজতাই পছন্দ করেন। তাই তিনি দ্বীনকেও মানুষের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। নামাজ দাঁড়িয়ে পড়ার হুকুম থাকলেও, দাঁড়াতে অপারগ হলে বসে পড়ার সুযোগ আছে। আবার বসতে সমস্যা হলে, শুয়ে শুয়েও পড়া যায় নামাজ! কোনো কারণে অযু করা অসম্ভব হলে, তায়াম্মুম করলেও অসুবিধা নেই।

সামগ্রিকভাবে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনেও দেখা যায় সাধারণত্ব। এক্ষেত্রে উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.)-এর একটি হাদীস উল্লেখ করা যায়—

তিনি বলেন, ‘একদিন রাসূল (সা) আমাকে বললেন, “হে আয়িশা! তোমাদের কাছে কি খাওয়ার মতো কিছু আছে?” আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের নিকট কিছুই নেই।’ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তা হলে আমি রোযা রেখে দিচ্ছি।”’   (মুসলিম, ১১৫৪)

নবিজি চাইলে খাবার সংগ্রহের জন্য ব্যতিব্যস্ত হতে পারতেন। এতে দোষের কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি রোযা রেখে জীবনকে আরও সহজ করে নিলেন। 

ক্ষমা মহৎ গুণ

জীবনে চলার পথে নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য বা ঝগড়া-বিবাদ হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে অন্তরে কারো প্রতি ক্ষোভ, হিংসা অথবা রাগ-অভিমান রাখা যাবে না। কারণ, এগুলো নিজেরই বেশি ক্ষতি করে। নিজের সুখের জন্যই অন্যকে ক্ষমা করতে হবে, মনকে করতে হবে প্রশস্ত। কাউকে ক্ষমা করলে, ক্ষমাকারীর হৃদয়ে আত্মিক প্রশান্তি অনুভূত হয়। তাই, রাগ, ক্ষোভ ও হিংসাকে ‘না’ বলতে হবে, মানুষকে ক্ষমা করতে হবে।

রাসূল (সা)-এর জীবনে ক্ষমার অসংখ্য নজির দেখা যায়। যেন তিনি সবসময় ক্ষমা করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। একবার এক বেদুইন এসে নবিজির চাদর ধরে সজোরে টান দিলো। অতঃপর তাঁর কাছে বায়তুল মাল হতে সাহায্য চাইলো। নবিজি আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও এতটুকু বিরক্তি প্রকাশ না করে স্মিতহাস্যে বললেন—“তাকে বায়তুল মাল হতে কিছু দিয়ে দাও।” এভাবে সারা জীবন রাসূল (সা) ক্ষমা করেছেন। যে মুশরিকরা তাঁকে জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য করল, হত্যার ষড়যন্ত্র করল, অকথ্য নির্যাতন করল, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন : 

لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللَّهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ اذْهَبُوا فَأَنْتُمْ الطُّلَقَاءُ

“আজ তোমাদের ওপর কোনো ভর্ৎসনা নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আর তিনি সবচেয়ে বেশি দয়ালু।”   (নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা, ১১২৩৪; সূরা ইউসুফ, ১২:৯২)

প্রত্যেকে মোরা পরের তরে

অন্যকে কিছু দেয়ার মধ্যে, অন্যের জন্য কিছু করার মধ্যে যে কী অনাবিল আনন্দ—তা শুধু অনুভব করা সম্ভব; ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ইসলাম এ ব্যাপারে অসংখ্য নির্দেশনা প্রদান করেছে। প্রতিবেশীর অধিকার, আত্মীয়ের অধিকার, পথশিশুর অধিকার, দরিদ্রের অধিকার, দান-সদাকা, যাকাত প্রভৃতি বিধান সমাজের সবাইকে নিয়ে সুখী থাকার জন্য। আর যে অন্যের সুখের জন্য কোনো কিছু করে, আল্লাহ তাআলা তার সুখের ব্যবস্থা করে দেন। হাদীসে এসেছে : 

“আল্লাহ বান্দাকে সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করে।”   (মুসলিম, ২৬৯৯)

‘তুলনা’-কে না বলুন!

সুখী হওয়ার জন্য কৃতজ্ঞচিত্ত হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার জন্য কত কী আছে, তার হিসেব করে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীতে শুধু ‘বেঁচে আছি’ বলেই প্রতিটি মুহূর্তে পড়া উচিত ‘আলহামদুলিল্লাহ’। 

অথচ দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, মানুষ নিজের সুখের হিসেব কষে অন্যের সাথে তুলনা করে। অথচ যাকে দেখে মানুষ আফসোসের অনলে পোড়ে, সে নিজেও হয়তো অন্য কাউকে দেখে মারাত্মক হতাশায় ভুগছে। সত্যিকার অর্থে দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই সম্ভাবনাময়। আপন চেষ্টা-সাধনা আর সংগ্রামের মাধ্যমে প্রত্যেকেই অনন্যসাধারণ হবার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই ভুল করে—শুরুতেই নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করে বসে। সামান্য সময়ের জন্যও তারা ভাবেন না—যারা সফল হয়েছে, তাদের সফলতার পেছনে কত সংগ্রাম ও ধৈর্য রয়েছে। তাই, সুখ-সচেতন মানুষ হিসেবে সকলের কর্তব্য হলো, প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া, নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা করা!

মনের সুখ-ই বড়

প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—

“চারটি জিনিসের ভেতর সুখ আছে। উত্তম স্ত্রী, প্রশস্ত বাসগৃহ, ভালো প্রতিবেশী এবং সুন্দর বাহন।”   (ইবনু হিব্বান, সহীহ, ৪০৩২)

রাসূল (সা)-এর জীবনীতে তাকালে দেখা যায়, ‘উত্তম স্ত্রী’ ছাড়া তাঁর জীবনে বাকিগুলো তেমন একটা ছিল না। অথচ তিনি একজন সুখী মানব ছিলেন। তাই নির্দ্বিধায় এ-কথা বলা যায়, হৃদয়ের প্রাচুর্যে ঐশ্বর্যশীল ব্যক্তিরাই প্রকৃত সুখী। 

রাসূল (সা) অপর এক হাদীসে বলেছেন : 

“সম্পদের আধিক্য হলে ধনী হয় না; অন্তরের ধনীই প্রকৃত ধনী।”   (বুখারি, ৬৪৪৬)

মাত্রাতীত আশা-ই হতাশার কারণ

জীবন চলার পথে আশার লাগাম টেনে ধরা জরুরি। সাধারণত মানুষ পরস্পরের কাছে অথবা নিজেই নিজের কাছে মাত্রা ছাড়িয়ে আশা করে। মানুষ কত বেশি বেশি আশা করে, তা রাসূল (সা)-এর একটি হাদীস দ্বারা সহজেই বোঝা যায়। নবিজি বলেছেন : 

“যদি বনি আদমের স্বর্ণভরা একটা উপত্যকা থাকে, তথাপি সে তার জন্য দুটি উপত্যকা হওয়ার কামনা করবে। তার মুখ মাটি ব্যতীত অন্য কিছুতেই ভরবে না।”   (বুখারি, ৬৪৩৯)

অথচ বাস্তবতা হলো, বেঁচে থাকার জন্য জীবনে এত সম্পদের প্রয়োজন হয় না। তা ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকেই-বা কত দিন! তাই রাসূল (সা)-এর বাতলে দেয়া নির্দেশনা মেনেই ব্যক্তির জীবন পরিচালনা করা উচিত। আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার দু’কাঁধ ধরে বললেন—

“এই পৃথিবীতে এমনভাবে থাকো যেন তুমি ছিলে একজন অপরিচিত অথবা পথচারী।”

ইবনু উমর নিজেই বলতেন—

“সকালে জেগে উঠলে, বিকেল পর্যন্ত বেঁচে থাকার আশা করো না। আর বিকেলে বেঁচে থাকলে, সকালে জেগে ওঠার আশা রেখো না।”   (বুখারি, ৬৪১৬)

মুমিনের সবকিছু আল্লাহর জন্য

পৃথিবীতে মানুষ অহেতুক অসুখী হয়—অপর কেউ তাদের যথার্থ মূল্যায়ন করছে না বলে। প্রথম কথা হলো, মূল্যায়ন করার ক্ষমতা খুব কম মানুষের-ই থাকে। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তির কাজ তো অপরকে দেখানোর জন্য হওয়া উচিত নয়; হওয়া উচিত শুধু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। সকল কাজ যদি আল্লাহর জন্যই করা হয়, তবে তিনিই এর বেহিসাব প্রতিদান দেবেন। 

আশাবাদী হতে হবে আল্লাহর প্রতি

শয়তানের বড় একটি মিশন হলো, আল্লাহ তাআলার রহমত ও অনুগ্রহের ব্যাপারে মানুষকে হতাশ বানিয়ে ফেলা। কিন্তু একজন মুমিন কিছুতেই আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হতে পারে না। কুরআন কারীম সব সময়-ই মানুষকে আশাবাদী করে, সামনে এগিয়ে চলার উৎসাহ জোগায়। সে-রকম কিছু আয়াত এখানে উপস্থাপন করা হলো—

  • “দুশ্চিন্তা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।”   (সূরা তাওবা, ৯:৪০)

  • “আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। কেননা, কাফির কওম ছাড়া আর কেউই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না।”   (সূরা ইউসুফ, ১২:৮৭)

  • “নিশ্চয়ই দুঃখের সাথে সুখ আছে।”   (সূরা ইনশিরাহ, ৯৪:৬)

  • “তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না, আর তোমরাই বিজয়ী, যদি মুমিন থাকো।”   (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৩৯)

এ ছাড়া রাসূল (সা)-এর এই হাদীসটিও মুমিনদেরকে দারুণভাবে আশাবাদী করে—

“মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে সকল যাতনা, রোগ-ব্যধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমনকি যেই কাটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এসবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।”   (বুখারি, ৫৬৪১)

চাই আল্লাহর স্মরণ

“আর তিনি সেসব লোককে তাঁর পথ দেখান—যারা অনুশোচনা করে ফিরে আসে, আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে যারা স্থিরচিত্তে ঈমান আনে; মনে রাখবে, অন্তর স্থিরতা আসে আল্লাহকে স্মরণ রাখার মাধ্যমেই।”   (সূরা রা’দ, ১৩:২৭-২৮)

এ-আয়াতসহ উপর্যুক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহর প্রতি উত্তম বিশ্বাস এবং সৎকর্মের নির্দেশনা পাওয়া যায়। বলে রাখা ভালো—এগুলো মান্য করলেই যে মুমিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে না, তা নয়। তবে এটুকু অন্তত বলা যায়, আল্লাহর নির্দেশনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই মুমিনের হৃদয়ে নেমে আসে প্রশান্তি; জীবন হয়ে ওঠে সুখময়।

Related Articles