শাশ্বত ধর্ম ইসলামের প্রতিটি বাণী ও বিধান সমগ্র মানবজাতির জন্য অশেষ কল্যাণকর। অমুসলিম জাতিগোষ্ঠীর সাথে মুসলিমদের আচরণ কেমন হবে—এ ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সে-নির্দেশনার সারকথা হলো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করেই পালন করা যাবে নিজ নিজ ধর্ম। আর পরধর্মে সহিষ্ণুতা থাকলে, পৃথিবী হয়ে উঠবে বাসযোগ্য ও শান্তিময়।
অমুসলিমরা কি ‘বন্ধু’ হতে পারে?
আল্লাহ তাআলা বলেন :
“মুমিনরা যেন মুমিনদের ছাড়া কাফিরদেরকে অভিভাবক না বানায়। আর যে কেউ এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তোমরা যদি কাফিরদের অনিষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য এমনটা করো, তা হলে সেটা ভিন্ন কথা। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন এবং আল্লাহর দিকেই সকলের প্রত্যাবর্তন।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:২৮)
এই আয়াতে কাফির তথা অমুসলিমদেরকে ‘আউলিয়া’ বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ‘আউলিয়া’ অর্থ ‘বন্ধু’ হতে পারে। কিন্তু এখানে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য অর্থ হলো ‘অভিভাবক’। অর্থাৎ একজন মুসলিম কখনো অমুসলিমদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে না। তবে তাদের সাথে স্বভাবসুলভ বন্ধুত্ব বা ভালো আচরণ করাতে ইসলামের কোনো বাধা-নিষেধ নেই; এতে বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। এই যেমন কুরআন মাজীদের অপর আয়াতে এসেছে—
“দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন।” (সূরা মুমতাহিনা, ৬০:৮)
সমস্যা নেই সহজাত ভালোবাসাতেও
মুসলিম সমাজেও অনেক অমুসলিম ভাই-বোন থাকেন—যাদের সাথে মুসলিমদের ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। অথবা তারা মুসলিমদের সহপাঠী, সহকর্মী বা প্রতিবেশী। তাদের আন্তরিকতা বা দায়িত্বশীলতায় মুগ্ধ হলে, তাতে দোষের কিছু নেই। অনেক সময় অমুসলিম লেখক বা কবিদের সাহিত্যকর্ম ভালো লাগতে পারে। ধর্মীয় লেখা না হলে, সেক্ষেত্রেও কোনো অসুবিধা নেই।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবিক গুণসম্পন্ন অমুসলিমদের প্রতি সহজাত ভালোবাসা পোষণ করতেন। তাঁর চাচা আবু তালিব একজন অমুসলিম হলেও নবিজিকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক-সহ সকল ক্ষেত্রেই পিতার ন্যায় আগলে রেখেছেন। ফলে নবিজিও তাকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন।
খোঁজ নিতে হবে অমুসলিম প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের
প্রতিবেশীকে সম্মান করার ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে।” (মুসলিম, ৪৭)
নবিজি আরও বলেন, “যে আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।” (বুখারি, ৬১৩৮)
প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার এই যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। অর্থাৎ প্রতিবেশী ও আত্মীয় যেমনই হোক—মুসলিম হোক কিংবা না হোক—তার অধিকার অকাট্য ও অনস্বীকার্য।
ইসলামি শরীয়াতে রোগী দেখার বিধান শুধু মুসলমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল রুগ্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ হুকুম সমভাবে প্রযোজ্য। হাদীসের মাধ্যমে জানা যায়, একবার নবিজির এক ইহুদি খাদেম অসুস্থ হয়ে পড়লে, নবিজি তাকে দেখতে যান। (বুখারি, ১৩৫৬)
উপহার আদান-প্রদান
অমুসলিমরা কোনো উপহার প্রদান করলে সেটি গ্রহণ করা যাবে কি-না, এ নিয়ে অনেকের মধ্যে অনেক দ্বিধা-সংশয় কাজ করে। নবিজির জীবনীর ওপর আলোকপাত করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ষষ্ঠ হিজরীতে রাসূল (সা) তৎকালীন সমস্ত পরাশক্তি সাম্রাজ্যে দ্বীনের দাওয়াত-সম্বলিত চিঠি পাঠালেন। অনেকে ঈমান আনলেন, অনেকে আনলেন না। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহর উদ্দেশ্যে উপহার প্রেরণ করলেন। আর নবিজিও সেসব উপহার গ্রহণ করেছেন।
এক মহিলা আয়িশা (রা.)-এর কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী মাজুসি (অগ্নিপূজক)। তারা তাদের উৎসবের দিনে আমাদের জন্য উপহার পাঠায়।’ আয়িশা (রা.) বললেন, “তারা ওই উৎসব উপলক্ষ্যে যেই পশু জবাই করে তা খেও না। কিন্তু তারা শাক-সবজি দিলে তা খেতে পারো।” (আল-মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা, ৭/৫৮৭)
এ-হাদীস থেকে একটি স্পষ্ট হয় যে, অমুসলিমদের জবেহকৃত পশু ছাড়া অন্যান্য হালাল দ্রব্যাদি উপহার হিসেবে গ্রহণ করা যাবে।
ব্যবসায়িক লেনদেন জায়েয কি-না
অমুসলিমদের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন করা যাবে কি-না, এ ব্যাপারেও উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.) থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস বিধৃত হয়েছে—
আয়িশা (রা.) বলেন, “রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন ইহুদির কাছ থেকে বাকিতে কিছু খাবার কিনেছিলেন এবং তার কাছে লোহার বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন।” (মুসলিম, ১৬০৩)
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, অমুসলিমদের সাথে ‘স্বাভাবিক’ ব্যবসা-বাণিজ্য করাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বস্তুত, ইসলামি শরীয়াহ উম্মাহর জন্য এভাবেই সবকিছু সহজ করেছে। শরীয়াতের কাজই হলো মুমিনের জীবনকে সহজ ও গতিময় করা। আর তাইতো, শরীয়াহর অপর নাম জীবন।
নেওয়া যাবে রাজনৈতিক আশ্রয়
মক্কার কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে তায়েফ গমন করেন। কিন্তু সেখানেও তিনি নানান অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হন। বাধ্য হয়ে আল্লাহর রাসূল মক্কায় প্রত্যাবর্তনের চিন্তা করেন। তবে, চাচা আবু তালিব এবং স্ত্রী খাদীজা (রা.)-এর অনুপস্থিতির কারণে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই, দূত মারফত মক্কার লোকদের কাছে ‘আমান’ তথা রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন। শুরুর দিকে কেউ রাজি হতে না চাইলেও, মুতইম ইবনে আদি সমস্ত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নবিজিকে ‘আমান’ দিয়েছিলেন।
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রয়োজনে অমুসলিমদের থেকেও রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে। তবে, যার থেকেই কোনো প্রকার উপকার গ্রহণ করা হবে, তার প্রতিই নিঃসঙ্কোচিত কৃতজ্ঞ হতে হবে—বদর যুদ্ধ শেষে মুতইমকে স্মরণ করে রাসূল (সা) সেই বার্তাই সকলের কাছে পৌঁছেছেন। (বুখারি, ৪০২৪)
সম্মান পেতে হলে, সম্মান দিতে হবে
মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে যে যতটুকু সম্মান, স্বীকৃতি বা প্রশংসার দাবিদার, রাসূল (সা) তাকে ততটুকু সম্মান, স্বীকৃতি বা বাহবা দিতে কার্পণ্য করেননি। আল্লাহর রাসূল তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাছে চিঠি লিখিয়েছেন। তার একটি নমুনা এরকম—
“আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ হতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়সের প্রতি। যিনি হেদায়াতের অনুসারী, তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” (বুখারি, ৭)
কী চমৎকার চিঠি! চিঠির ভাষা! রাসূল (সা) এখানে হিরাক্লিয়সকে রোমের ‘আজীম’ বলেছেন। অমুসলিম হেতু চাইলে না-ও বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি এক্ষেত্রেও ছিলেন বিচক্ষণ এবং সূক্ষ্মদর্শী।
নবিজি কখনোই উপযুক্ত পাত্রের উপযুক্ত প্রশংসা করতে ভুলতেন না। উহুদ যুদ্ধের সময় মদীনার সকল ইহুদি চুক্তি ভঙ্গ করে মক্কার কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকলেও, ব্যতিক্রম ছিলেন মুখাইরিক। তিনি মুসলিমদের পক্ষে বীরের বেশে যুদ্ধ করতে করতে মারা গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাসূল (সা) এ কথা জানতে পেরে বললেন—“মুখাইরিক ইহুদিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।” (ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/৮)
শত্রু-অশত্রু চেনা
মুসলিমদের উচিত—শত্রু কাফির এবং অশত্রু কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা এবং যেসব কাফির কখনো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি, তাদের সাথে ইহসান ও অনুগ্রহের আচরণ করা। এক্ষেত্রে আবু জাহেল এবং আবু তালিব-এর প্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য। আবু জাহেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট ও দুঃখ দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই করেছে। অপরদিকে, আবু তালিব তার জীবনে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-ই পড়েননি শুধু; এ ছাড়া সকল দিক থেকে নবিজিকে আপন ছেলের চেয়েও অধিক যত্নে রেখেছেন। কাজেই, মুসলিম উম্মাহকে অবশ্যই বুঝে-শুনে অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
চাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
ঐতিহাসিক মদীনা সনদ-এর মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেছিলেন। সেই সনদের উল্লেখযোগ্য কিছু ধারা হলো—
সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদীনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে।
সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে।
কেউ কারও ওপর কোনোরূপ হামলা বা আক্রমণ করবে না।
সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় (হোক মুসলিম কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী) বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে, ওই আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে।
মুসলিম ভূখণ্ডে অমুসলিমদের অধিকার
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো চুক্তিবদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার করবে, বা তার হক নষ্ট করবে, কিংবা তার উপর কষ্ট চাপিয়ে দেবে বা তার সামর্থ্যের বাইরে কিছু করতে বাধ্য করবে, অথবা তার সন্তুষ্টিমূলক সম্মতি ছাড়া তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে বাদী হবো।” (আবু দাউদ, ৩০৫২)
বিশ্বাসে আঘাত করা যাবে না
কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন :
“ওহে মুমিনগণ! আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তারা ডাকে, তোমরা তাদেরকে গালি দিও না। কেননা, তারা তাদের অজ্ঞতাপ্রসূত শত্রুতার বশবর্তী হয়ে আল্লাহকে গালি দেবে। আর এভাবেই আমি প্রত্যেক জাতির জন্য তাদের কার্যকলাপকে তাদের দৃষ্টিতে চাকচিক্যময় করে দিয়েছি, অতঃপর তাদের প্রত্যাবর্তন (ঘটবে) তাদের প্রতিপালকের নিকট, তখন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিবেন যা কিছু তারা করত।” (সূরা আনআম, ৬:১০৮)
পরিশেষে বলা যায়, সাধারণ অমুসলিম ভাই-বোনদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়া যাবে। তবে, সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ সীমালঙ্ঘন করা যাবে না। আচরণের সৌন্দর্য আর হৃদয়ের ঔদার্য দ্বারা মুসলিমদের জয় করে নিতে হবে পুরো পৃথিবী।
Related Articles