পর্যায়ক্রমে সকল ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই || পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সৌজন্যবোধে তৈরি হোক ঐক্যের সেতু বন্ধন। কমে আসুক দূরত্ব। মজবুত হোক সম্প্রীতি।

Dr. Mizanur Rahman Azhari


mizan vai
প্যারেন্টিং লেসন

মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বিষয় নিয়ে পবিত্র কুরআন মাজীদ অত্যন্ত বোধগম্য ও গভীর অর্থবহ আলোচনা করেছে। সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলের পাশাপাশি ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনেও কুরআনের প্রভাব বিস্ময়কর। পারিবারিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা হবে কীরূপ, বা কীভাবে সন্তানদের প্রতিপালন করতে হবে—সে-ব্যাপারে বিস্তৃত দিক-নির্দেশনা এসেছে কুরআনে।

সূরা লুকমান

কুরআনের ৩১তম সূরা—সূরা লুকমান। কুরআন মাজীদের আটটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে ৮ জন মহান ব্যক্তির নামানুসারে। তাদের মধ্যে একজন লুকমান আলাইহিমুস সালাম—যিনি ছিলেন আল্লাহর একজন প্রিয়ভাজন বান্দা।

নিজ সন্তানের প্রতি লুকমান (আ)-এর উপদেশমালা এ-সূরার ১২-১৯ নং আয়াতে উঠে এসেছে। আজ থেকে ৩০০০ বছর আগেকার এই উপদেশবাণীর গভীরতা এত বেশি যে, বর্তমান প্রজন্মের জন্যও তা সমান উপযোগী। তাই, আধুনিক সময়ের প্রত্যেক সচেতন বাবা-মায়ের উচিত, সূরা লুকমানের তাফসীর জেনে, সন্তানদের সাথে তা শেয়ার করা।

কে ছিলেন লুকমান?

লুকমান (আ) গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলের কোনো এক জায়গায় তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তাঁর পেশা সম্পর্কে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হলো, একজন মনিবের অধীন থেকে তিনি মেষ চালনা করতেন। অর্থাৎ তিনি একজন দাস ছিলেন।

সারা দিন মাঠে মেষ চরিয়ে সন্ধ্যায় লুকমান (আ) যখন বাসায় ফিরতেন, তখন এলাকার লোকজন তাকে ঘিরে ধরত—তাঁর সুন্দর ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা শুনবার উদ্দেশ্যে। তিনি লোকদের অনুরোধ রাখতেন। এ ছাড়া তিনি নিজ সন্তানকে এমন চমৎকার সব উপদেশ দিয়েছেন যে, কুরআনে সেগুলো জায়গা করে নিয়েছে!

শিরকের চেয়ে বড় অপরাধ নেই

আল্লাহ তাআলা লুকমানকে হিকমা তথা প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। ‘প্রজ্ঞা’ হলো জ্ঞানের সঠিক উপস্থাপনা লুকমান (আ)-এর প্রতিটি কথার মাঝেই গভীর জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। এর একটি নমুনা তুলে ধরতে আল্লাহ তাআলা বলেন—

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

“যখন লুকমান তার ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘ছেলে আমার, তুমি আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শিরক করা মহা অন্যায়।’”   (সূরা লুকমান, ৩১:১৩)

একজন আদর্শবান ও নৈতিকতাবোধ-সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, লুকমান (আ) তাঁর সন্তানকে উপদেশ দিয়েছেন। একটি সুন্দর-সুখময় পারিবারিক জীবন গঠনের জন্য পরিবারভিত্তিক এই উপদেশ-চর্চার বিকল্প নেই। আবার, এ উপদেশগুলো হতে হবে অত্যন্ত কোমল, মোলায়েম। লুকমান (আ) এখানে তার সন্তানকে ডাকছেন يَا بُنَيَّ বলে। يَا بُنَيَّ শব্দের সহজ বাংলা অর্থ হলো—‘হে আমার কলিজার টুকরা!’; ‘হে আমার আদরের ছোট্ট সোনামানিক!’ যুগে যুগে প্রত্যেক নবি-রাসূলই এভাবে নরম ও কোমল ভাষায় নিজ-নিজ উম্মাহকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে আহ্বান করেছেন।

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়—লুকমান তাঁর পুত্রকে প্রথম যে উপদেশটি দিয়েছেন, সেটি হলো—আল্লাহর সাথে শিরক না করা। আর এই উপদেশবাণীর শেষ অংশটি হলো : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শিরক করা মহা অন্যায় (বা বড় জুলুম)।’

‘জুলুম’ শব্দটির সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য অর্থ হলো—কারো অধিকার হরণ করা। কোনো বান্দার সমস্ত ইবাদাত পাবার একক অধিকার রাখেন কেবল আল্লাহ তাআলা। এর বিপরীত কিছু করাই হলো আল্লাহ তাআলার প্রতি জুলুুমের নামান্তর। তাই সকলের উচিত, আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে কোনো কিছু না চাওয়া। কেবল তাঁরই ইবাদাত করা ও ছোট-বড় সকল প্রকার জুলুম থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখা।

প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত—সন্তানদেরকে এসব ব্যাপারে সচেতন করা। কেননা, আল্লাহ তাআলা চাইলে সব গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, কিন্তু শিরকের গুনাহ তিনি কখনোই ক্ষমা করেন না। বাবা-মায়েদের কর্তব্য, সন্তানদেরকে ধরে ধরে ছোট-বড় প্রতিটি পাপ সম্পর্কে অবহিত করা। তাদেরকে ইসলামি তারবিয়া তথা ভদ্রতা, নম্রতা, হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য কথা, আমানতদারিতা, মুরব্বিদের সম্মান, লজ্জাশীলতা, আল্লাহর ভয়, পরকালের জবাবদিহিতা, চুরির ভয়াবহতা, অন্যের হক পালনের গুরত্ব প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া।

পাশাপাশি, বর্তমান সময়ের সন্তানদেরকে সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, অনলাইনে কোন ধরনের সাইট ব্রাউজ করে—এ সবকিছু নজরদারিতে রাখা উচিত। এ ছাড়া সকল ওয়েব ব্রাউজারে ‘প্যারেন্টিং কন্ট্রোল’ সেট করে দিতে হবে। কারণ পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই, এসবের মাধ্যমে যতটা সম্ভব তাদের বিপথে যাবার পথ রোধ করতে হবে।

আল্লাহ সব জানেন এবং দেখেন

লুকমান তাঁর প্রিয় পুত্রকে আরও বলেছেন—“ছেলে আমার, (তোমার কোনও ভালো কিংবা খারাপ কাজ) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আর সেটা যদি কোনও শিলাখণ্ডের ভেতর, অথবা মহাকাশে কিংবা জমিনে থাকে—আল্লাহ সেটা অবশ্যই হাজির করবেন; আল্লাহ অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ।”   (সূরা লুকমান, ৩১:১৬)

সূরা যিলযালে বলা হয়েছে, “অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে, তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কর্ম করলে, তা-ও দেখতে পাবে।”   (সূরা যিলযাল, ৯৯:৭-৮)

পিতা-মাতার উচিত—শৈশবেই আল্লাহ তাআলার কাছে হিসাব-নিকাশের ব্যাপারটি সন্তানদেরকে অবহিত করা। যদি ছোট বয়সেই তারা জবাবদিহিতার ব্যাপারে সচেতন হয়ে যায়, তা হলে বড় হয়ে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে না, ইন শা আল্লাহ।

সালাত প্রতিষ্ঠা করা মুমিনের কর্তব্য

পিতা তাঁর পুত্রকে বলছেন—

یٰبُنَیَّ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ

“হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম করো।”   (সূরা লুকমান, ৩১:১৭)

এখানে সালাত কায়েম করবার উপদেশ এসেছে। আর এ-কথা সকলেরই জানা যে, একা একা কোনো কিছু কায়েম করা যায় না। কোনোকিছু কায়েম করতে হলে, তা করতে হয় সামষ্টিকভাবে । ঠিক তেমনি, জামাতের সাথে পরিপূর্ণভাবে সালাত আদায় করলেই কেবল সালাত কায়েম হয়। তাই, ছোট্ট ছোট্ট সোনামণিদের জামাতের সালাতের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তারা যেন বিকেলবেলা খেলা শেষ করে, বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে মসজিদে যায়—এ-ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে।

এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব গ্রহণ করা হবে। যদি নামাজ ঠিক থাকে, তাহলে বাকি আমলও ঠিক হবে। আর যদি নামাজ খারাপ হয়, তবে বাকি আমলও খারাপ হবে।

চাই ভালো কাজে আদেশ; মন্দ কাজে নিষেধ

লুকমান (আ) তাঁর পুত্রকে আরও বলেছেন—“সৎ কাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ করো।”   (সূরা লুকমান, ৩১:১৭)

তার মানে, ব্যক্তিকে শুধু একা একা ভালো বা সৎ হলেই হবে না। সমষ্টিগতভাবে সৎ হতে হবে। কেননা, সমাজের কোনো ব্যক্তি বা অংশ যদি খারাপ কাজে লিপ্ত থাকে এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি সেখানে বাধা দেয়া না হয়, তবে এর কুফল ভোগ করতে হবে সমাজের সকল শ্রেণিকে। এজন্য সমাজের যেকোনো অন্যায়মূলক কর্মকাণ্ডে সকলকে একসাথে রুখে দাঁড়াতে হবে।

বিপদে ধৈর্য ধরাই শ্রেষ্ঠ গুণ

পিতা তাঁর পুত্রকে ধৈর্যের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন—“তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধরো। নিশ্চয়ই এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।”   (সূরা লুকমান, ৩১:১৭)

ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপত্তি বাধে। প্রবল শত্রুতা সৃষ্টি হয়, কাঁধে চেপে বসে হাজারো বিপদ। কারাবরণ, নির্বাসন কিংবা শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়।  সত্যনিষ্ঠ মানুষেরা পথের এই কণ্টকাকীর্ণতা জেনেই সামনে অগ্রসর হন এবং কঠিন ধৈর্য অবলম্বন করেন। একই সাথে তারা প্রত্যাশা করেন আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি।

এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সকল সচেতন বাবা-মায়ের উচিত—শৈশব থেকেই সন্তানদেরকে ধৈর্যের সবক দেওয়া। তাদেরকে কষ্টসহিষ্ণু করে গড়ে তোলা। চাওয়া-মাত্র কোনোকিছু পেয়ে গেলে, তাদের চাহিদার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই এ-ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা উচিত। তাদেরকে বুঝতে দিতে হবে, জীবন এত সহজ নয়, বরং বড্ড কঠিন। এখানে প্রবল ধৈর্য আর কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে টিকে থাকতে হয়।

অহংকার পতনের মূল

মহান বাবা তাঁর আদরের সন্তানকে বলছেন—

وَ لَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ

“আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।”   (সূরা লুকমান, ৩১:১৮)

এখানে লুকমান (আ) নিজ সন্তানকে সামাজিক হবার শিক্ষা দিচ্ছেন। সচেতন বাবা-মায়ের উচিত—শিশুদেরকে মোবাইলে ডুবিয়ে না রেখে, মানুষের সাথে মেশানো। কারণ, ছোটবেলা থেকেই সামাজিক হয়ে গড়ে উঠলে, বড় হয়েও তারা মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াবে।

মধ্যম পন্থাই উত্তম পন্থা

লুকমান (আ) তাঁর ছেলেকে আরও বলেছেন—“চলাফেরায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, আর গলার আওয়াজ নিচু রাখো, নিঃসন্দেহে গাধার আওয়াজই সবচেয়ে বিশ্রী আওয়াজ!”   (সূরা লুকমান, ৩১:১৯)

পুত্রের প্রতি পিতার এ উপদেশের মাধ্যমে আমাদের শারীরিক অঙ্গভঙ্গির (Body language) প্রতি আবারও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শুধু হাঁটা-চলার ক্ষেত্রে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত। এই উম্মাহকে হতে হবে বিনয়ের সর্বোত্তম উদাহরণ। কেননা, সমাজে বিনয়ীরাই হয় বরণীয়, আর কর্কষভাষীরা সর্বদা পরিত্যাজ্য।

প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি লুকমান (আ) একজন বাবা হিসেবে নিজ সন্তানের প্রতি উত্তম উপদেশাবলি তুলে ধরেছেন। আদর্শ অভিভাবক হিসেবে লুকমান (আ) মুসলিম উম্মাহর কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, পূর্ণ প্রজ্ঞা ও ভালোবাসার সাথে এসব উপদেশ নিজ সন্তানদের সামনে তুলে ধরা। এ-সকল উপদেশ বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে একটি আলোকিত ও আদর্শিক সমাজ।

Related Articles