পর্যায়ক্রমে সকল ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই || পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সৌজন্যবোধে তৈরি হোক ঐক্যের সেতু বন্ধন। কমে আসুক দূরত্ব। মজবুত হোক সম্প্রীতি।

Dr. Mizanur Rahman Azhari


mizan vai
কুরআন মাজীদ: বিশ্ব মানবতার হিদায়াত

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেলেও, গোটা মানবজাতি পরিপূর্ণ আলোর দিশা পেয়েছে—এমনটি বলার সুযোগ নেই। কেননা, মানুষের মধ্যে আজও বাসা বেঁধে আছে অজ্ঞতা ও অস্পষ্টতা। নানামুখী সংঘাত ও শঙ্কার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ-সবকিছুর পেছনে একমাত্র কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় মানুষের জীবন-যাপনের পদ্ধতিকে। সভ্যতার স্বর্ণ-শিখরে পৌঁছুতে হলে, মানবজাতিকে তাদের-স্রষ্টার-দেওয়া-ম্যানুয়াল—আল-কুরআন—অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। কুরআন মাজীদ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন : 

وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ

“আর আমি তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)দের জন্য পথনির্দেশ, করুণা ও সুসংবাদস্বরূপ।”   (সূরা নাহল, ১৬:৮৯)

সর্বাপেক্ষা জীবনঘনিষ্ঠ কিতাব

অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও জীবনঘনিষ্ঠ এক কিতাব—আল-কুরআন। সকল কিতাব নাযিল হয়েছে একবারে, একসাথে। আর কুরআন নাযিল হয়েছে একটু একটু করে, প্রয়োজনের তাগিদে, প্রেক্ষাপটের আলোকে। কখনো মক্কার পথে, কখনো-বা মসজিদে, ঘরে, সফরে কিংবা যুদ্ধের ময়দানে—নবিজি তাঁর পরিবার বা সমাজ-রাষ্ট্রে যখনই কোনো সমস্যা ও সঙ্কটের মুখোমুখী হয়েছেন, তখনই সমাধান ও দিক-নির্দেশনা নিয়ে হাজির হয়েছে পবিত্র কুরআন।

ঐশী আলো

পুরো একটি জাতি ও ভূখণ্ডের জীবনধারা বদলে গিয়েছিল এ মহাগ্রন্থের সোনালি পরশে। জাহেলি যুগের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষগুলো এই পবিত্র কুরআনের প্রভাবেই আঁধার ছেড়ে আলোর পথের দিশা পেয়েছিল। সত্য ও সুন্দর পথে চলতে শিখেছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন : “আর আমি তোমাদের প্রতি প্রকৃষ্ট আলো অবতীর্ণ করেছি।”   (সূরা নিসা, ৪:১৭৪)

সত্য-মিথ্যার পার্থক্য তুলে ধরে

কুরআনের লেন্স দিয়ে যখন এ দুনিয়াকে পরখ করা হবে, তখন কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, সেটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কুরআনে এসেছে

تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَىٰ عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا

“তিনি বরকতময়, যিনি তাঁর বান্দার ওপর ফুরকান নাযিল করেছেন যেন সে জগতবাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে।”   (সূরা ফুরকান: ২৫:১)

চিরন্তন মুজিযা

যুগে যুগে পৃথিবীতে অনেক আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে। আজ পর্যন্ত সেসব কিতাবের কোনোটিই অবিকৃত অবস্থায় নেই। অপরদিকে, কুরআন কারীম হলো চিরন্তন মুজিযা (Timeless Miracle)। কুরআন চিরকাল অবিকৃত অবস্থাতে থাকবে। পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কুরআন কারীম বিশ্ব মানবতাকে হিদায়াত দিতে থাকবে এবং মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়ে যাবে।  

কেন প্রয়োজন কুরআনি নির্দেশনা?

মানবজীবনের নানামুখী সঙ্কটে বিজ্ঞান ও দর্শন এগিয়ে এসেছে, বিভিন্ন প্রশ্নের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করেছে। কিন্তু এমন কিছু সমস্যা বা প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলোর সমীকরণ ওহীর দিক-নির্দেশনা ছাড়া মেলানো সম্ভব নয়। তাই, মানুষকে সেসকল প্রশ্নের উত্তর জানাতে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে কিতাব পাঠিয়েছেন। কুরআন মাজীদ হলো আল্লাহর পাঠানো সকল দিক-নির্দেশনার আধুনিক সংস্করণ।

কুরআন কারীম আছে বলেই মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা পেয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন : 

وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ

“আমি জীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদাত করার জন্য।”   (সূরা যারিয়াত, ৫১:৫৬)

কুরআনের বদৌলতেই মানুষ আখিরাতের ব্যাপারে জানতে পেরেছে। আখিরাতের অস্তিত্ব যদি না থাকত, কিংবা মানুষের জীবনে যদি কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও না থাকত, তা হলে গোটা পৃথিবীটাই পরিণত হতো তামাশার বস্তুতে।

কুরআনের শিক্ষণপদ্ধতি 

মানুষের মেধা-মনন ও মস্তিষ্কের সক্ষমতা অনুসারেই কুরআন তাদেরকে শিক্ষা প্রদান করে। কুরআন মাজীদকে কঠিন ও দুর্বোধ্য করে নাযিল করা হয়নি; বরং সকল মানুষের জন্য সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল করে নাযিল করা হয়েছে। এখানে কুরআন-এর কিছু শিক্ষণপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো।

শাশ্বত কালামের মাধ্যমে :

ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে উমর (রা) একদিন চুপিচুপি নবিজির পেছনে এসে দাঁড়ান। রাসূল (সা) তখন নামাজের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। উমর (রা) সে-তিলাওয়াত শুনছিলেন আর তাঁর মনের সকল দ্বিধা-সংশয় দূর হয়ে যাচ্ছিল। তিনি মনে মনে নবিজিকে কবি ও গণক ভাবলে, কুরআন উত্তর দেয়

“এটা কোনো কবির কথা নয়। তোমরা তো বিশ্বাসই করছো না! এটা কোনো গণকের কথাও নয়। তোমরা তো একেবারেই মাথা খাটাচ্ছ না! এ তো মহাবিশ্বের অধিপতির কাছ থেকে পাঠানো বার্তা।”   (সূরা হাক্কাহ, ৬৯:৪১-৪৩)

উপমার সাহায্যে নির্দেশনা :

ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া কখনো মুমিনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে না। পবিত্র কুরআন কারীম এ-কথাটাই চমৎকার উপমা দিয়ে উপস্থাপন করেছে—

“(যারা দুনিয়ায় প্রাচুর্য পেয়ে অহংকারী হয়ে ওঠে,) তাদের দুনিয়ার জীবনের উপমা তুলে ধরো। (তাদের জীবন যেন) পানির মতো, যা আমি আকাশ থেকে নামিয়ে আনি, এরপর জমিনের উদ্ভিদ তা শুষে নেয়, (তারপর সেসব উদ্ভিদ চমৎকারভাবে বিকশিত হয়,) তারপর উদ্ভিদ পরিণত হয় শুকনো খড়কুটোয়, বায়প্রবাহ যাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়! আল্লাহর সবকিছুর ওপর সর্বময় ক্ষমতার ‍অধিকারী।”   (সূরা কাহাফ, ১৮:৪৫)

বিভিন্ন কথোপকথন তুলে ধরে : 

আল্লাহর ক্ষমতা ও একত্ববাদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে নবি ইবরাহীম (আ.) ও অত্যাচারী ক্ষমতাধর বাদশাহ নমরুদের মধ্যকার কথোপকথন কুরআন এভাবে তুলে ধরছে— 

“তুমি কি সে-ব্যক্তির কথা ভেবে দেখোনি, যে ইবরাহীমের সঙ্গে তার রবের ব্যাপারে তর্কে লিপ্ত হয়েছিল? (তর্কে লিপ্ত হওয়ার) কারণ, আল্লাহ তাকে শাসনক্ষমতা দিয়েছিলেন। ইবরাহীম বলল, ‘আমার রব তিনি—যিনি জীবন দেন আবার মৃত্যু ঘটান।’ সে বলল, ‘আমিও জীবন দিতে পারি, মৃত্যুও ঘটাতে পারি।’ ইবরাহীম বলর, ‘আল্লাহ পূর্বদিক থেকে সূর্য ওঠান, তা হলে তুমি সেটা পশ্চিম দিক থেকে ওঠাও।’ অবাধ্য লোকটি তখন হতভম্ভ হয়ে যায়। যারা অন্যায়ে লিপ্ত থাকে, আল্লাহ তাদেরকে পথ দেখান না।”   (সূরা বাকারা, ২:২৫৮)

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে : 

কুরআনে আল্লাহ তাআলা বেশ কয়েকজন নবি ও তাঁদের জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সেই ইতিহাসে কখনো উঠে এসেছে নবি-রাসূলদের সংগ্রামী জীবন, আবার কখনো উঠে এসেছে তাঁদের জনগোষ্ঠীর লাগাতার অবাধ্যতার কথা। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে ফিরআউন, নমরুদ, আদ-সামুদ জাতি ও কওমে লূতের ন্যাক্কারজনক পরিণতির ঘটনা। এসকল ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরবার মাধ্যমে কুরআন সমগ্র মানবজাতিকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দেয়।

কুরআনি নির্দেশনা

একটি সফল, সুন্দর ও সার্থক জীবন গঠনের জন্য পবিত্র কুরআন মাজীদ মানবজাতির উদ্দেশ্যে বহু নির্দেশনা প্রদান করেছে। 

সৃষ্টির সেবাই পরম ধর্ম : 

মহান আল্লাহ তাআলা এই পৃথিবীতে মানুষকে দায়িত্বশীল করে পাঠিয়েছেন। প্রত্যেকের উচিত যার যার জায়গা থেকে এই পৃথিবীকে সবার জন্য বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন : “যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করব।’”   (সূরা বাকারা, ২:৩০)

এই আয়াতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে, মানুষ চাইলেই যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা বা প্লাস্টিক ফেলে পরিবেশ দূষণ করতে পারবে না। ইচ্ছেমতো পাহাড় কাটতে পারবে না। বনায়ন ধ্বংস করতে পারবে না। বরং, নির্মল পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবাইকেই সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

পড়ো, তোমার প্রভুর নামে : 

ইসলাম-ই একমাত্র ধর্ম, যার প্রথম নির্দেশনাপড়ো। জীবনকে আল্লাহর রঙে রাঙাতে জ্ঞান-সাধনার বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন : 

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ

“পড়ুন, আপনার রবের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।”   (সূরা আলাক, ৯৬:১)

আল্লাহ তাআলার এই আদেশ ব্যাপক-বিস্তৃত। ধর্মীয় বিধি-নিষেধ জানার পাশাপাশি জাগতিক সমস্ত জ্ঞানে মুসলিমদের পারদর্শী হতে হবে। মুসলিম জাতির পূর্বসূরিরা জ্ঞানের সকল শাখায় সফল বিচরণ করেছেন। এজন্যই তৈরি হয়েছে আল-বিরুনী, আল-খারেজমি, ইবনুল হাইসাম, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল-ইদ্রিসি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনার মতো জগদ্বিখ্যাত বিদগ্ধজনদের। আমাদের উচিত তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।

মুসলিমরা একে অপরের ভাই-ভাই : 

আল্লাহ তাআলা এই পৃথিবীতে মুসলিমদেরকে ভ্রাতৃত্ব বজায় রেখে চলতে বলেছেন। এর নেপথ্যে সুন্দর এক যুক্তিও তিনি দেখিয়েছেন। কুরআনে এসেছে

“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।”   (সূরা হুজুরাত, ৪৯:১৩)

মধ্যমপন্থাই উত্তম পন্থা : 

ইসলাম বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি কোনোটিই পছন্দ করে না। ইসলাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের উৎসাহ প্রদান করেছে। কুরআন কারীমের অমোঘ ঘোষণা

“আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর।”   (সূরা বাকারা, ২:১৪৩)

অমুসলমিদের সাথেও ন্যায়পরায়ণতা : 

ইসলাম শুধু মুসলিমদের সাথে সাম্য ও ন্যায় অবলম্বনের কথা বলেনি; বরং অমুসলিমদের সাথেও চমৎকার আচরণের নির্দেশ প্রদান করেছে। মুসলিমদের এই আচরণিক বিভায় মুগ্ধ হয়েই যুগে যুগে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন

“আল্লাহর দেওয়া জীবনাদর্শকে কেন্দ্র করে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের বাড়িঘর থেকে তোমাদেরকে বের করে দেয়নি—তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না; যারা ইনসাফ করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।”   (সূরা মুমতাহিনা, ৬০:৮)

সব থেকে সুন্দর পরিশ্রমের জীবন : 

ইসলাম তার অনুসারীদেরকে সব সময় নিজের পায়ে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা বা অন্যের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি করাকে ইসলাম কখনোই অনুমোদন দেয়নি। আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন

“অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।”   (সূরা জুমুআ, ৬২:১০)

Related Articles